করোনা প্রকোপ: শুটিংয়ের পক্ষে-বিপক্ষে তাঁরা!
করোনা ভাইরাসের প্রকোপে থমকে বিশ্ব জনজীবন। মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে। দেশে দেশে চলছে লকডাউন। স্বাস্থ্যবিদরা ঘরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। সকল ধরনের শুটিং বন্ধ। বিপাকে পড়েছেন নাট্যসংশ্লিষ্টরাও। গত রবিবার আন্তঃসাংগঠনিক সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে গোপনে আদিবাসী মিজান নামক এক নাট্যপরিচালক শুটিং করতে গিয়ে ধরা খাওয়ার পর আন্তঃসংগঠনের চাপে ফিরে আসায় স্বস্তি ফিরলেও; অস্তত্বি দেখা দিয়েছে অভিনয় শিল্পীসংঘের সভাপতি শহীদুজ্জামান সেলিমের বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে।
গত মঙ্গলবার (১২ মে) ছোটপর্দার নির্মাতা সাখাওয়াত মানিক সরকারি ও সংগঠনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গোপনে বিজ্ঞাপনের শুটিং করেন। এতে আরও অংশ নেন চিত্রনায়ক নিরব, আমন রেজা, চিত্রনায়িকা শিরিন শিলা, সেমন্তী সৌমি, ফখরুল বাশার মাসুম ও নজরুল রাজ। এতে করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন নাট্যসংশ্লিষ্টরা।
তাদের ভাষ্য আমাদের ঘরে থাকতে বলে নেতা কেন শুটিংয়ে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন তাদের মনে। তাবে অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিং করার ইচ্ছে পোষণ করছেন। কেউ কেউ স্ট্যাটাসেও তাদের অভিমত ব্যক্ত করছেন। আবার কেউবা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক নয়। অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন আন্তঃসংগঠনের নীরব ভূমিকা নিয়েও। সমসাময়িক এ প্রসঙ্গ নিয়ে নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতিক্রিয়া পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
জনপ্রিয় অভিনেতা ও নাট্যনির্মাতা শামীম জামান বলেন, এখন আর কেউকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। রাজাও ঘরে বসে খেলে গোলা খালি হয়ে যায়। সবাই শুটিংয়ের উপর নির্ভরশীল। আউটডোর না হোক এই মুহূর্তে অন্তত ইন হাউজ শুটিংয়ের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। আমি সভাপতি সালাউদ্দিন লাভলু ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব রেখেছি। আমার নিজেরও শুটিং করা দরকার ছিল।
তবে সংগঠনকে সম্মান দেখিয়ে এবং দেশের কথা চিন্তা করে করিনি। তাছাড়া নাটক ছাড়া টেলিভিশন চলতে পারছে না। বৈশাখ গেলো নাটক ছাড়া। সামনের ঈদেও নতুন নাটক নেই। আমার কাছে মনে হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ইন হাউজ কাজের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। সবাই কাজের প্রয়োজন অনুভাব মনে করছে। নাটক কেন্দ্র করে ঈদ চলে।
একজন পরিচালকের সাথে ৩০-৪০ জন লোক কাজ করে। পরিচালকের অনেক দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু একজন শিল্পীর দায়বদ্ধতা নেই। কারণ সে একা কাজ করে চলে আসে। পরিচালকের সাথে যে ইউনিটের লোকগুলো কাজ করে কাজ না থাকায় তাদের বেহাল দশা। সব দিক বিবেচনা করে এখন শুটিংয়ের অনুমতি দেওয়া উচিৎ। না হলে আরও ভুল বোঝাবুঝি হবে বলে মনে করছি। অবশ্য সবকিছু ঠিক করার এখতিয়ার আন্তঃসংগঠনের।
জনপ্রিয় নাট্যকার চয়নিকা চৌধুরী এ মুহুর্তে শুটিং শুরুর বিপক্ষে। তিনি বলেন, দেশে যে অবস্থা চলছে তাতে যে কারোই শুটিং করা ঠিক হবে না। সবার উচিত সরকারের নিয়ম মেনে ঘরে থাকা। একটা শুটিং কখনো এক দুজন দিয়ে হয় না। শুটিং করতে গেলে ১৫-২০ জন লোকের দরকার হয়। করোনা যেহেতু ছোঁয়াছুঁয়ি সে ক্ষেত্রে আমরা রোম্যান্টিক দৃশ্য কিংবা মা ছেলেকে আদর করার এমন কোন দৃশ্যের শ্যুট করতে পারবো না। সরকারের লকডাউন শেষ না হওয়া পর্যান্ত এবং প্রোপার স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কাজ শুরু করলে আমি কাজ করবো না।
কানাডায় অবস্থানরত শক্তিমান অভিনেত্রী অরুনা বিশ্বাসের ভাবনাটা আবার ভিন্ন। তিনি বলেন, দুর্যোগ এসেছে তাই ভাবনার সময় এটাই। সব শিল্পী-ডিরেক্টরদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চাই। নাটক বা চলচ্চিত্রের ওপরও বিমা হতে পারে। তাহলে আপতকালীন রিস্ক কাভার দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি চলমান অবস্থায় সরকারের নির্দেশিত পথে থাকটাকেই সঠিক মনে করছেন এই অভিনেত্রী।
নঈম ইমতিয়াজ নেয়ামুল বলেন, নাটকের শুটিং বন্ধর জন্য সরকারি নির্দেশনা ছিল না। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং সরকারের লক ডাউন সাধুবাদ জানিয়ে সংগঠন শুটিং বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। এ পেশার সাথে জড়িত শতশত মানুষ। কাজ বন্ধ থাকায় তারা পড়েছেন বিপাকে। অনেকেই আর্থিক সংকটে পড়েছেন। সবাই একটা দুঃসময় পার করছেন। সংগঠনের উচিৎ কর্মপন্থা অবলম্বন করা।
আমি একটি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ের পরিকল্পনা করতেছি। আমি মনে করি সকল দিক বিবেচনা করে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংগঠনের উচিৎ শুটিংয়ের অনুমতি দেওয়া। গত দুই মাসে ঘরবন্দি থেকে মোটামুটি আমাদের সকলের মধ্যে সচেতনা এসেছে। সে দিক থেকে সবাই যতেষ্ট সচেতনার সাথে কাজ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
অভিনেতা মাহমুদুল হাসান মিঠু (বড়দা মিঠু) বলেন, আমরা সবাই নাটকের উপর নির্ভরশীল। কাজ বন্ধ থাকায় সবার অবস্থা নাজেহাল। তবে দেশের কথা বিবেচনা করে সংগঠন কাজ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এরকম কতদিন কাজ বন্ধ করে থাকা যায়? আমাদের জীবন-জীবিকা নাটকের উপরই নির্ভরশীল। তাই আমি মনে করছি স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিংয়ের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। আশা করছি আন্তঃসংগঠনগুলো বিষয়টি ভেবে দেখবেন।
এদিকে, অভিনেত্রী মুনিরা মিঠু বৃহস্পতিবার রাতে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেন, আসুন আমরা সকল মান অভিমান হিংসা বিদ্বেষ ভুলে সবাইকে আপন করে নেই। এবং সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে, সকল নিরাপত্তার সহিত কার্যক্রম শুরু করি। সেই পোষ্টে সহমত পোষণ করেন অভিনেতা তারিক স্বপন ও ওবিদ রেহান।
নাট্যনির্মাতা শ্রাবণী ফেরদৌস বলেন, শুটিং তো করতেই হবে। শুটিং করেই আমাদের জীবন-জীবিকা চলে। তাই মনে করি একটা নিয়মের মধ্যেই সবার কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত আসা দরকার।
ঊর্মিলা শ্রাবন্তী কর বলেন, অভিনয় শিল্পী সংঘের যে কোন সিদ্ধান্তে একমত। আমি মনে করি সংগঠন যেটা ভালো মনে করে সেটিই করবেন। তবে সাধারণ ছুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারলে ভালো হয়।
অভিনেতা সিদ্দিক বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিং করার পক্ষে আমি। কারন দীর্ঘ দুই মাস ধরে সবাই বেকার হয়ে বাসায় অবস্থান করছি। কাজ না থাকায় বর্তমানে কেউ ভালো নেই। হাতেগোনা কয়েক জন শিল্পী চাইলে আরও দুই মাস বসে খেতে পারবে। কিন্তু নিম্নআয়ের শিল্পীরা কিন্তু পারবে না। তাদের কথা বিবচেনা করে সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুটিং করা যেতে পারে।
জিনাত শানু স্বাগতা বলেন, আমরা শুটিং করেই জীবিকা নির্ভর করি। আমি আরো দুই মাস চাইলে ঘরে বসে খেতে পারবো। কিন্তু অন্যারা তো বেকার হয়ে পড়ে আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে কাজ করা গেলে ভালো হয়। তবে সংগঠন যে সিদ্বান্ত নিবে তাতে আমি একমত।
সুচনা আজাদ বলেন, করোনা সহজেও যাচ্ছে না। কাজও বন্ধ রাখাও সম্ভব নয়। দিনদিন আক্তান্তর সংখ্যা বাড়ছে। আর কয়েকদিন দেখে সব কিছু বিবেচনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঈদের পর কাজ করা যেতে পারে। সানিতা রহমান সামান্তা জানান, সংগঠন যে সিদ্ধান্ত নিবে তাতে আমি সাধুবাদ জানাই।
অপরদিকে অভিনেতা এস এন জনি বলেন, আমাদের এমন কোন কাজ করা উচিত নয় যেটা মানুষের জন্য খারাপ হয়। সরকার যতদিন অনুমতি না দেয় ততদিন দেশের কথা চিন্তা করে কাজ বন্ধ রাখা উত্তম। তবে সংগঠন যদি কোন সিদ্ধান্ত নেয় আমার আপত্তি নেই।
পরিচালক মাবরুর রশিদ বান্নার মতে, আরো কিছুদিন দেখা উচিৎ। কেননা আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা প্রত্যেক দিনই বাড়ছে। আর কাজ তো শুরু করতেই হবে। তবে গাইডলাইন আর সেইফটি মেজার্স গুলো কি হবে সেটা ১০০% ক্লিয়ার করতে হবে। এবং সবাইকে সেটা মানতে হবে। যে নূন্যতম গড়িমসি করবে তার সঙ্গে সঙ্গে শুটিং বন্ধ করে দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরাতে হবে।
অভিনেতা অনুভব মাহবুব বলেন, সবার আগে সরকারি বিধি নিষেধের সাথে আমি একমত। সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায় আমি শুটিং করবো না। এবং আমাদের অভিনয় শিল্পী সংঘের থেকে যখন অনুমতি দেয়া হবে তখন শুটিং করতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি অভিনয় শিল্পী এবং এটাই আমার একমাত্র পেশা তাই সবকিছু ঠিক থাকলে আমি অবশ্যই শুটিং করতে চাই।
ওপরের প্রতিক্রিয়ার আলোকে দৈনিক আমাদের সময়ের বিনোদন প্রধান মঈুন আবদুল্লাহ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি শুটিং করার পক্ষে। কারণ হাজার হাজার শিল্পী ও কলাকুশলী শুটিংয়ের উপর নির্ভরশীল। কাজ না থাকায় তারা বেকার হয়ে বসে আছেন। সরকার থেকে যদি কোন সহযোগিতা পেতো তাহলে শুটিং করার কথা ভাবতে হতো না। যেহেতু তাঁরা কোন সুবিধা পায়নি। সামনে ঈদ অথচ এ পেশার সাথে জড়িত কেউ ভালো নেই। তাই আমি মনে করি স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে ঈদের আগে কিছু শুটিংয়ের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। আশা করছি সংগঠন গুলো তাদের শিল্পী ও কলাকুশলীদের কথা বিবেচনা করে সময় উপযোগী একটি সিদ্ধান্ত নিবেন।
অপরদিকে দৈনিক আজকালের খবরের বিনোদন বিভাগের প্রধান আহমেদ তেপান্তর বলেন, সরকার একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সহায়তা দিয়ে যেতে পারবে এরপর…? দীর্ঘ সময়ে নিজেকে ঘরে রাখলে না খেয়ে মরতে হবে, বাইরে গেলেও মরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যদি কাজ করার প্রতিশ্রুতি সবার থেকে আদায় এবং কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে অবশ্যই এ মুহুর্তে শুটিং শুরু করা উচিৎ।
মানুষ অবসাদে ভুগছে এই সত্যটাও মানতে হবে। তাছাড়া গোপনে কয়েকটি টিম কাজ করছে বলেও জেনেছি। তাদের ব্যাপারে কিন্তু সংগঠনকে বড় পদক্ষেপ নিতে দেখিনি। এ অবস্থা যতদূর জেনেছি অনেকেই আন্তঃসংগঠনের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। আমার মনে হয় আন্তঃসংগঠনকে সাংগঠনিক স্বার্থকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য শুটিং করতে দেওয়া উচিৎ হবে।
লিখেছেন রুহুল আমিন ভূঁইয়া।