শাহজাহান সৌরভ : পরিচালনাই যার মূল লক্ষ্য

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : দর্শকদের চাহিদার কথা চিন্তা করে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নানা দিকে আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে। সিনেমার মেকিং, গল্প বলার ধরন, সিনেমাটোগ্রাফি, কোরিওগ্রাফি, বাজেট, নবাগত কিছু দক্ষ এবং মেধাবী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ডেডিকেশন, একঝাক নতুন কিন্তু সম্ভাবনাময় নির্মাতার আগমনে প্রাণ ফিরে পাবার আশায় আছে আমাদের বেহাল ইন্ডাস্ট্রি।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে নানা বিষয়ে এখন পরিবর্তন আসছে যদিও পরিবর্তনের হার বা অনুপাত খুবই কম এবং এটি হচ্ছে ধীরলয়ে। তবুও এই পরিবর্তন আমাদের ধুকতে থাকা ইন্ডাস্ট্রি আবার বেগবান করতে একটি বড় পদক্ষেপ রাখতে যাচ্ছে তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। একটি সিনেমার মুল স্তম্ভ হচ্ছে তার গল্প। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের সিনেমায় ভিন্নধর্মী এবং নতুন প্রেক্ষাপট লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আয়নাবাজি, অজ্ঞাতনামা, ডুব, হালদা, দেবী, টেলিভিশন, স্বপ্নজাল, সত্তা, ঢাকা অ্যাটাক, দহন, কমলা রকেট সহ আরো কিছু নান্দনিক এবং ভিন্নধর্মী সিনেমার দেখা পেয়েছি আমরা। যাদের নিত্যনতুন চিন্তা এবং লেখনী শক্তির মাধ্যমে আস্তে আস্তে বদল আসছে আমাদের সিনেমায় তাদের মধ্যে এই সময়ের অন্যতম আলোচিত এবং দক্ষ একটি নাম হলো শাহজাহান সৌরভ। নাটক এবং সিনেমা দুটি মাধ্যমেই এই সময়ে কাজ করছেন তিনি।

আলোচিত এবং ব্যবসাসফল ‘ঢাকা অ্যাটাক’ সিনেমার চিত্রনাট্যে তার লেখা এছাড়া বর্তমানে বিগবাজেটের কিছু আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত সিনেমার গল্পও লিখেছেন তিনি। ‘গিরগিটি’ ‘স্বপ্নবাজি’ ‘পরান’ এবং ‘ইত্তেফাক’ এর মতো আলোচিত সিনেমা আছে এই তালিকায়। সাম্প্রতিক এসব কাজের মধ্য দিয়েই ইতিমধ্যে তিনি প্রমাণ করেছেন এই সময়ের কাহিনীকারদের মধ্যে তিনি নিজস্ব দক্ষতা এবং মেধা দিয়েই কাজ করতে এসেছেন আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে।

তবে কাহিনীকার হিসেবে পরিচিতি পেলেও শাহজাহান সৌরভের আল্টিমেট লক্ষ্য কিন্তু পরিচালনা। প্রায় ৫ বছর পরে একটি বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং দিয়ে তিনি ফিরছেন পরিচালকের ভূমিকায়। এই বিষয়টি নিয়েই এই বিশেষ ফিচার।

করোনা পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আস্তে আস্তে সরব হচ্ছে মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি। স্বল্প পরিসরে সচেতনতার সাথে সকল নিয়মনীতি মেনে কাজ শুরু হচ্ছে। কাজে ফিরছেন প্রযোজক,পরিচালক, শিল্পী এবং কলাকুশলীরা। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমবার বিজ্ঞাপন নির্মাতা হিসেবে কাজ শুরু করলেন শাহজাহান সৌরভ।

এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসনের অর্থায়নে পরিচালক হিসেবে একটি সরকারি তথ্যচিত্র নির্মান করেছিলেন তিনি। কিছুদিন আগে একটু বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেই বিজ্ঞাপনের শ্যুটিং সম্পন্ন করেছেন তিনি। গাজীপুরে তাদের নিজস্ব রিসোর্ট এবং আশেপাশের কিছু জায়গায় সাবধানতার সাথে একদিনেই বিজ্ঞাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

একদিনের মধ্যে একই বিজ্ঞাপনের দুটি আলাদা ভার্সন শ্যুট করা একেবারে সহজ কাজ ছিলোনা। তবে সকল শিল্পী এবং ক্যামেরার পেছনের মানুষদের আন্তরিকতায় কাজটা করা সম্ভব হয়েছে বলে জানান সৌরভ। ভিন্নধর্মী কনসেপ্ট নিয়ে নির্মান করা বিজ্ঞাপনচিত্রটি সকলের ভালো লাগবে বলেই আশা করেন তিনি।

করোনাকালে কেমন কাটছে দিনকাল জানতে চাইলে তিনি জানান, আসলে এই সময়ে তো সামগ্রিক ভাবে আমরা সবাই ভালো মন্দ মিলিয়েই যাচ্ছি। সকল কাজ বন্ধ তাই স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা সমস্যা তো হচ্ছেই তবে আল্লাহ তায়ালার রহমতে সবাইকে নিয়ে সুস্থ আছি এটাও বা কম কি! এই ফাকা সময়টাতে গাজীপুরে নিজেদের রিসোর্ট এর বিভিন্ন কাজ এবং প্ল্যানিং করা হয়েছে। আরো সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি বা কিছু বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় পাওয়া গেছে। পরিবারের সদস্যদের সাথে এরকম লম্বা একটা সময় একসাথে কাটানোটাও একটা বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন তিনি।

তবে করোনা পরিস্থিতি ইন্ডাস্ট্রির জন্য বেশ বড় একটি ধাক্কা বলেই মনে করেন সৌরভ। কারন কয়েকমাস আগেও শুধু মুখের কথার উপর বিশ্বাস করেই অভিনয় শিল্পী বা নির্মাতা এবং প্রোডাকশনের মানুষজন লাখলাখ টাকার কাজ করেছেন। সম্পর্কটা সহজ আর স্বাভাবিক ছিলো। আস্থা বা নির্ভরতার সেই জায়গাটা আজ ব্যক্তিগত সুরক্ষা বা সাবধানতার কারনে একটু নড়বড়ে। আর সাথে আর্থিক বিষয়টাতো আছেই।

একজন জনপ্রিয় শিল্পীর পারিশ্রমকের কারনে হয়তো আরো ৩ মাস কাজ না করেও থাকতে পারবেন কিন্তু একজন প্রোডাকশন বয় বা অন্যান্য কলাকুশলীরা কাজ না থাকার দরুন জীবন-যাপনের প্রক্রিয়ায় অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। পুরোপুরিভাবে কাজ শুরু না হলে সামনে হয়তো তার বা তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় হবে। কাজের সংখ্যা এখন খুব কম এবং নিরাপত্তার জন্য খুব কম সংখ্যক মানুষ নিয়েই কাজ করা হচ্ছে। তাই এইসব সমস্যা থেকে উত্তরনের ব্যাপারগুলো নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার ভাবনা জানতে চেয়েছিলাম এই হাসিখুশি এবং শিল্পকে ভালোবেসে কাজ করে যাওয়া মানুষটার কাছে। শাহজাহান সৌরভ তখন বলেন- আমি খুব আশাবাদী। আমাদের সিনেমা একটা ট্রাঞ্জিশানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমি বলি এটা আমাদের জন্য নিউ ওয়েভ আর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, খুব সৎ জায়গা থেকে যে সিনেমাগুলো তৈরি হবে এখন; সেগুলো ব্যর্থ হবে না। অবিশ্বাস্য, উদ্ভট (এ্যাবসার্ড নয় কিন্তু), ক্লিশে, নকল গল্প এখন আর দেখতে চায়না মানুষ। সামনে আরও চাইবে না।

দর্শক এখন খুব সচেতন, খুবই গ্লোবাল। গাঁটের পয়সা খরচ করে যিনি টিকিট কাটবেন, তাকে ঠকানোর সুযোগ আর নেই একদম। আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির ভবিষ্যৎ অনেকগুলো যোগফলের ওপর দাঁড়িয়ে। প্রজেকশানের স্বচ্ছ ব্যাবস্থাপনা বা ই-টিকেটিং, পর্যাপ্ত হল, হলের ভাল পরিবেশ, ওভারসিজ ডিস্ট্রিবিউশান, মৌলিক কনটেন্ট আর ওয়েল মেইড সিনেমা যদি ধারাবাহিক হয়; তাহলে ইন্ডাস্ট্রি গতিশীল হবে নিশ্চিতভাবেই।

এই ট্রাঞ্জিশান পিরিয়ডটাতে ফিল্ম মেকারদের সাহস ধরে রাখতে হবে আর সরকারী-বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা এগিয়ে আসতে হবে। ভাল মানের হল বাড়াতে হবে এখন; কোটি কোটি দর্শক মুখিয়ে আছে ভাল পরিবেশে, ভাল সিনেমা দেখার জন্য। ভালো সিনেমার কোন বিকল্প নাই এই ইন্ডাস্ট্রি বাঁচানোর জন্য। করোনা পরবর্তী সময়ে আরো বেশি উৎসাহ এবং পজেটিভিটি নিয়ে সবাইকে এক হয়ে এই ইন্ডাস্ট্রির জন্য এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই।

আর সবকিছুর মতো এই খারাপ সময়টাও কেটে যাবে বলে মনে করেন তিনি। আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করা ছাড়া তো বিকল্প নাই তাই সেটা যেমন করতে হবে তেমনি নিজেদের যোগ্যতা, মেধা এবং পরিশ্রম দিয়ে সামনের দিনগুলিতে আরো ভালো কাজ করার প্রতিজ্ঞাও নিতে হবে। একদিন সব স্বাভাবিক হবে সেদিনের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি থাকাটাও খুব জরুরি বলে মনে করেন এই স্বপ্নবাজ মেধাবী তরুন লেখক এবং নির্মাতা। শুভকামনা রইলো তার জন্য।

Ad