৩৮তম জন্মদিনে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া জোনাস

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : ভাবলে অবাক হতে হয়, যে মেয়েটির গায়ের কালো রং নিয়ে তার আত্নীয়-স্বজন থেকে শুরু করে বন্ধুরা কটুক্তি করতো সেই মেয়েটি ১৮ বছর বয়সে সারা দুনিয়ার সব সুন্দরী মেয়েদের পেছনে ফেলে বিশ্বসুন্দরীর মুকুট নিজের করে নিয়েছিলেন। তার পরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার। তাকে ”বিউটি উইথ ব্রেন” এই কথাটির পারফেক্ট উদাহরন বললেও কম বলা হবে। বলিউডের পর হলিউড জয় করা এই মেয়েটি প্রমান করেছেন শুধুমাত্র চেস্টা এবং স্বপ্ন জয় করার মনোবল যদি দৃঢ় হয় তাহলে সাফল্য আসবেই। বলা হচ্ছে বলিউডের ‘দেশি গার্ল’ প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার কথা। আজ এই জনপ্রিয় বলিউড অভিনেত্রীর জন্মদিন। তার জন্মদিন উপলক্ষে আজকের এই বিশেষ ফিচার।

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার জন্ম ১৯৮২ সালের ১৮ জুলাই। তার বাবা প্রয়াত অশোক চোপড়া এবং মা মধু চোপড়া দুজনেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিকিৎসক ছিলেন। তার পিতা পাঞ্জাবি এবং আম্বালার অধিবাসী ছিলেন এবং তার মা ঝাড়খণ্ডের অধিবাসী। তার একমাত্র ছোট ভাই সিদ্ধার্থ তার থেকে সাত বছরের ছোট কিন্তু এখন তার মায়ের পরে তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সাথে একটা বন্ধুসুলভ বন্ডিং তৈরী হয়েছিলো তার। যা পিতার মৃত্যুর পরেও এখনো এক সুতোয় বেধে রেখেছে তার পরিবারকে।

ভারতীয় হিন্দি চলচ্চিত্রের একজন দক্ষ এবং ব্যাপক জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী এবং কণ্ঠশিল্পী তার অভিনয় এবং গান দিয়ে জয় করেছেন পাশ্চাত্যের মানুষের মনও। ২০০০ সালে তিনি মিস ওয়ার্ল্ড উপাধি লাভ করেন। তারপরেই সাধারন সেই মেয়েটির জীবন বদলে যায়। তবে নেপোটিজম নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা মত থাকলেও বলিউডের প্রিয়াঙ্কা চোপড়া এন্ট্রি নেন একেবারেই আউটসাইডার হিসেবে। কোনো গডফাদার বা স্বজনপ্রীতি না থাকার পরেও শুধুমাত্র মেধা, অভিনয় দক্ষতা, নিজের সৌন্দর্য্য এবং কঠোর পরিশ্রমের দ্বারাই প্রিয়াঙ্কা চোপড়া নিজেকে বলিউড তথা হলিউডে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে।

২০০২ সালে তামিল ‘ঠামিজান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তার অভিষেক হয় এই রঙিন ঝলমলে দুনিয়ায়। তবে ২০০৩ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র তথা বলিউডে তিনি সানি দেওলের বিপরীতে ‘দ্য হিরো’ সিনেমার মাধ্যমেই প্রবেশ করেন। একই বছর ‘আন্দাজ’ সিনেমার জন্য তিনি সেরা নবাগতা অভিনেত্রী হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এরপর ২০০৪ সালে ‘এইতরাজ’ সিনেমায় ভিলেন রোলে অভিনয় করে শোরগোল ফেলে দেন তিনি। নবাগতা অভিনেত্রী হলেও অক্ষয় কুমার এবং কারিনা কাপুরকে ছাপিয়ে এই সিনেমায় তার চরিত্রটি প্রশংসার সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নেন। বছরের সেরা ভিলেন হিসাবে ফিল্মফেয়ার লাভ করেন তিনি। একই বছর সালমান খান এবং অক্ষয় কুমারকে সাথে নিয়ে রোমান্টিক কমেডি ‘মুঝছে সাদি করোগে’র বক্স অফিস সাফল্য তাকে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে বক্স অফিসে প্রতিষ্ঠিত করে। সিনেমায় তার অভিনয়, লুক এবং জনপ্রিয় কিছু গান তাকে এগিয়ে নিয়ে যায় আরো অনেকটা পথ।

২০০৬ সালে হিরো প্রধান দুটি ব্যবসায়িক ভাবে সফল এবং প্রশংসিত সিনেমা হৃতিক রোশানের সাথে ‘কৃষ’ এবং শাহরুখ খানের সাথে ‘ডন’ বলিউডে তার জায়গা শক্ত করে। দুটি সিনেমাতেই নায়িকা হিসাবে তার অভিনয় এবং চরিত্রের সাথে মিশে যাওয়ার দক্ষতা প্রশংসা কুড়ায়। তবে সত্যিকার অর্থে ইন্ডাস্ট্রির সফল তারকা খেতাব পান ২০০৮ সালে। ওইবছর ‘ফ্যাশন’ সিনেমায় তার মনোমুগ্ধকর অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন। এবং একই বছর সুপারহিট ‘দোস্তানা’ সিনেমায় তার লুক, নাচ, ড্রেস ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। সিনেমার জনপ্রিয় একটি গান ‘দেশী গার্ল’ এর জনপ্রিয়তা এবং প্রিয়াঙ্কার ক্রেজের কারনে রাতারাতি ‘দেশি গার্ল’ খেতাব পেয়ে যান তিনি।

এরপরে ধারাবাহিকভাবেই প্রতিবছর অসাধারণ কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। ২০০৯ সালে বিশাল ভরদ্বাজের ‘কামিনে’ হোক বা ২০১১ সালে একই পরিচালকের ‘সাত খুন মাফ’ প্রিয়াঙ্কা প্রমান করেছেন তিনি সব চরিত্রেই নিজের পুরোটা দিয়ে চরিত্রটির প্রতি জাস্টিফাই করতে সক্ষম। ২০১২ সালে অনুরাগ বাসুর ক্ল্যাসিক ‘বারফি’ প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ক্যারিয়ারের অন্যতম একটি মাইলফলক। প্রতিবন্ধী ‘ঝিলমিল’ চরিত্রে প্রিয়াঙ্কা এতোটাই মিশে গেছেন যে তাকে ছাড়া এই চরিত্রে অন্য কাউকে ভাবা যায়না আজো। রনবীর কাপুরের সাথে তার জুটিও ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিলো। ২০১৪ সালে ‘মেরি কম’ বায়োপিকে প্রিয়াঙ্কার পারফরম্যান্স জয় করে সকলের মন। সমালোচক থেকে সাধারন দর্শক সবাইকে মুগ্ধ করেন তিনি। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য কঠোর শারীরিক পরিশ্রম এবং শরীর চর্চার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে, শিখতে হয়েছিলো বক্সিং এর প্রাথমিক নানা নিয়ম কানুন। ২০১৩ সালে গায়িকা হিসেবে তার অ্যালবাম ‘ইন মাই সিটি’ ঝড় তোলে আমেরিকান টপচার্টে। আমেরিকায় জনপ্রিয় হবার দরুন আসতে থাকে নানা অফার। এর মাঝেই প্রিয়াঙ্কার হলিউড থেকে কিছু প্রজেক্টে কাজের প্রস্তাবের কারনে আমেরিকায় থিতু হবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

তবে বলিউডে তুরুপের তাস যে এখনো খেলা বাকি, ২০১৫ সালে সঞ্জয় লীলা বানসালীর ম্যাগনাম ওপাস ‘বাজিরাও মাস্তানী’ সিনেমায় কাশিবাঈ চরিত্রে তিনি এতোটাই উজ্জ্বল ছিলেন যে স্বয়ং অমিতাভ বচ্চন মূল চরিত্রের রনভীর সিং এবং দীপিকা পাডুকোনের পাশাপাশি তার অভিনয় নিয়ে আলাদাভাবে শুভেচ্ছা জানিয়ে মেসেজ লিখে পাঠান তাকে। এই সিনেমায় প্রথমার্ধে তার হাসিখুশি এবং প্রানবন্ত পেশোয়া রানীর চরিত্র থেকে দ্বিতীয়ার্ধে স্বামীর প্রতারনা এবং অবহেলা সাথে নিয়েই প্রথম স্ত্রীর মর্যাদা ধরে রেখে নিস্প্রানভাবে বেচে থাকা দর্শকদের মনে নাড়া দিয়ে যায়। তার চোখের এক্সপ্রেশন এবং কিছু ডায়লগ আজো দাগ কেটে যায়। এই সিনেমার জন্য ফিল্মফেয়ারে সেরা প্বার্শ অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে অন্যন্য একটি রেকর্ড করেন প্রিয়াঙ্কা। একজন অভিনেত্রী হিসেবে সেরা নবাগতা, সেরা ভিলেন, সেরা অভিনেত্রী (সমালোচক), সেরা অভিনেত্রী (পপুলার) এবং সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রী হিসেবে আলাদা আলাদাভাবে পাচটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জয়ের রেকর্ড একমাত্র তারই আছে। একই বছর জয়া আখতারের ‘দিল ধাড়াকনে দো’ সিনেমায় বিত্তশালী পরিবারের মেয়ে এবং আরেক বিত্তশালীর অসুখী স্ত্রী হিসেবেও চমৎকার অভিনয় করেন তিনি।

দেশের আংগিনা ছেড়ে আমেরিকান টিভি সিরিজ ‘কোয়ান্টিকো’ তাকে ইন্টারন্যাশনাল তারকার স্বীকৃতি এনে দেয়। এই সিরিজে অভিনয় করে তিনি প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি পপুলার চয়েজ পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জয় করেন। তাও দুইবার। হলিউডের জনপ্রিয় ‘বেওয়াচ’ সিনেমায় ভিলেনের রুপে তার গ্ল্যামারাস লুক তাক লাগিয়ে দেয়। প্রিয়াঙ্কাই একমাত্র ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি ব্রিটিশ রয়েল ওয়েডিংয়ে অতিথি হিসেবে যাবার আমন্ত্রন পেয়েছেন। প্রিন্স হ্যারি এবং মেগান এর বিয়েতে আমন্ত্রন পান তিনি। এমনকি অস্কার আসরেও তার উপস্থিতি নজর কাড়ে সবার। তবে এতো স্বীকৃতি এবং ভালোবাসা পেয়েও একটুও বদলে যাননি পিগি চপস। এখনো আগের মতোই হাস্যোজ্জ্বল এবং আন্তরিক তিনি। ২০১৬ সালে তিনি ভারত সরকার প্রদত্ত চতুর্থ বেসামরিক পুরস্কার পদ্মশ্রী অর্জন করেন এবং টাইম ম্যাগাজিন প্রকাশিত তালিকায় শীর্ষ ১০০ প্রভাবশালী নারী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। এছাড়া ইউনিসেফের ‘গুড উইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এই প্রজেক্টের অংশ হিসেবে একটি সফরে বাংলাদেশের টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে গেছেন তিনি।

অভিনয়ের পাশাপাশি নিজের প্রোডাকশন হাউজ খুলেছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। মারাঠী, বাংলা,পাঞ্জাবি এরকম আরো অনেক অঞ্চল ভিত্তিক সিনেমা প্রযোজনা করেন তিনি। যার মধ্য দিয়ে তিনি নতুন কিন্তু দক্ষ শিল্পী দের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছেন। ‘পার্পেল পেবেল পিকচার’ নামের এই প্রোডাকশন হাউজ ২০১৬ সালে তাদের প্রযোজিত মারাঠা মুভি ‘ভেন্টিলেটর’ জন্য জাতীয় পুরস্কার ঘরে তুলেছে। গতবছর ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’-খ্যাত বলিউডের বাঙালি পরিচালক সোনালি বসুর পরিচালনায় ‘স্কাই ইজ পিংক’ সিনেমায় তার অভিনয় নতুন করে আলচনায় আসে। জায়রা ওয়াসিম, ফারহান আখতারের মতো দক্ষ অভিনয় শিল্পীদের সাথে চুটিয়ে অভিনয় করেন তিনি। বক্স অফিসে সফলতা না পেলেও সমালোচকদের প্রশংসা পান তিনি।

এই সময়ে এসে বিনোদনের নতুন মাধ্যম ওটিটি প্ল্যাটফর্মের অন্যতম জনপ্রিয় সাইট নেটফ্লিক্সের কিড সুপারহিরো বেইজড ড্রামা ‘উই ক্যান বি হিরোস’ এ অভিনয় করছেন তিনি। এছাড়া বলিউডের এই সময়ের অন্যতম দক্ষ অভিনেতা রাজকুমার রাওয়ের সাথে জুটি বেধে ‘হোয়াইট টাইগার’ সিনেমায় হাজির হচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা। হোয়াইট টাইগার পরিচালনা করবেন রামিন বাহরানি। এটিও নেটফ্লিক্সে রিলিজ দেয়া হবে। এছাড়া আরো কয়েকটি প্রজেক্টে দেখা যাবে প্রিয়াঙ্কাকে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই ঘোষনা দিতে যাচ্ছেন তার আগামী কাজগুলো নিয়ে। তবে জনপ্রিয় ‘ম্যাট্রিক্স’ সিরিজের চতুর্থ কিস্তিতে প্রখ্যাত হলিউড অভিনেতা কিয়ানু রিভস এবং অ্যানে মসের সাথে স্ক্রিন শেয়ার করতে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা এটা নিশ্চিত।

অক্ষয় কুমার, শহীদ কাপুর, শাহরুখ খানের সাথে প্রেমের গুঞ্জন থাকলেও তিনি নিজের থেকে দশ বছরের জুনিয়র আমেরিকান জনপ্রিয় গায়ক নিক জোন্সের সাথেই সাত পাকে বাধা পড়েন। কিছুদিন প্রেম করার পর ভারতের যোধপুরে রাজকীয় বিয়ের আয়োজন করে বিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন তারা। হিন্দু এবং খৃস্টান দুই রীতিতেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন প্রিয়াঙ্কা এবং নিক। স্বামীর সাথে আমেরিকাতেই বসবাস করছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের নানা মূহুর্ত, নিজেদের ভালোবাসা এবং জীবনযাপন ভক্তদের সাথে শেয়ার করেন এই সাবেক বিশ্বসুন্দরী।

ক্যালেন্ডারের হিসেবে ৩৮টি বসন্ত পার করা একজন সফল গায়িকা,অভিনেত্রী, প্রযোজক প্রিয়াঙ্কা চোপড়া তার দক্ষ অভিনয় এবং অসাধারন সৌন্দর্য দিয়ে পাড়ি দিবেন আরো অনেকটা পথ তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। ক্যারিয়ারের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনেও সুখ এবং আনন্দেই কাটুক তার আগামী জীবন এই কামনা রইলো।

Ad