চলচ্চিত্রের রাজপুত্রের জন্মদিন

আফজালপুর ফেরদৌস রুমন : বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম চিত্রনায়ক সালমান শাহ। সালমান শাহ এই নামটা শোনার সাথে সাথে এক সুদর্শন তরুন যার চোখে গোল ফ্রেমের সানগ্লাস, কপাল আর মাথার সামনের চুল রুমাল দিয়ে বাঁধা, কখনো মাথায় হরেক রকমের ক্যাপ বা টুপি। কখনো স্যুটেড-ব্যুটেড অথবা কখনো সাধারণ ঘরের ছেলের লুঙ্গি-স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে কখনো আবার জিন্স আর পোলো টিশার্ট পরিহিত এক অসাধারন আকর্ষণীয় যুবক। আবার কখনো টিশার্ট আর তার ওপর বোতাম খোলা ডেনিম শার্ট।

জিন্সের হাঁটুর দিকটা একটু ছেঁড়া, আবার কখনো সেখানে রুমাল দিয়ে বাঁধা। আর সবশেষ পায়ে কেডস বা রুচিশীল জুতো। আর ফ্যাশনেবল সানগ্লাসের কথা নাইবা বললাম। নিজের সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা দারুণ মানানসই ফ্যাশনসেন্স, মন কেড়ে নেয়া হাসি আর সহজ, সাবলীল অভিনয় দক্ষতায় ঢাকাই চলচ্চিত্রের নায়কদের সিংহাসন নিজের নামে করে নিয়েছিলেন এই চলচ্চিত্রের রাজপুত্র। ১৯৭০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মানে আজকের দিনে তিনি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৮৬ সালের দিকে হানিফ সংকেতের গ্রন্থনায় ‘কথার কথা’ নামের একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রচার হতো। এর একটি পর্বে হানিফ সংকেতের গাওয়া ‘নামটি ছিল তার অপূর্ব’ শিরোনামের গানের মিউজিক ভিডিওতে মডেল হওয়ার মাধ্যমেই সালমান শাহ সবার নজর কাড়েন। তখন অবশ্য তিনি ইমন নামেই পরিচিত ছিলেন। গায়ক হিসেবেও সালমানের পরিচিতি ছিল। ছোটবেলা থেকেই শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি দারুণ আগ্রহ ছিল তার।

বন্ধুমহলে সবাই তাকে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে চিনতেন। ১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লীগীতিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। কয়েক বছর পর প্রয়াত নাট্যজন আব্দুল্লাহ আল মামুনের প্রযোজনায় ‘পাথর সময়’ ধারাবাহিক নাটকে একটি ছোট চরিত্র এবং কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছিলেন। তবে রূপালি পর্দায় সালমান সাম্রাজ্যের সূচনা হয় ৯০ দশকের শুরুর দিকে আরেক নবাগতা নায়িকা মৌসুমীর বিপরীতে সোহানুর রহমান সোহানের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। দুজনেই এক সিনেমা দিয়ে নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের সোনালি পাতায়।

মাত্র সাড়ে তিন বছরের অভিনয় জীবন। উপহার দিয়েছেন মাত্র ২৭টি সিনেমা। সব শ্রেণির দর্শক-সমালোচকদের মন জয় করে তারকা হওয়ার জন্য সময়টা যথেষ্ট নয়। কিন্তু তিনি মহাতারকা হয়ে দেখিয়েছেন তার যোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা। প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ থেকেই দর্শকদের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন যা এখনো অটুট। এতটা জায়গা নায়করাজ রাজ্জাক-পরবর্তী সময়ে কেউ নিতে পারেননি। কে জানে হয়তো অল্প সময়ের জন্য এসেছিলেন বলেই এত দ্যুতি ছড়াতে পেরেছিলেন, কেটে গেছেন দাগ। যে দাগটা তার প্রস্থানের টানা ২৪ বছর পরেও এতটা জ্বলজ্বলে। তার অনুপস্থিতি আর অকাল প্রস্থান আজও পোড়াচ্ছে অগনিত মানুষের মন।

সালমান শাহের অকাল মৃত্যু আজও এক রহস্য! বাংলা চলচ্চিত্রে তার কট্টর ভক্তদের কথা কারো অজানা নয়। তার মৃত্যুর প্রায় দুই যুগ হয়ে গেলেও ভক্তরা তাকে একটু ভোলেনি। বরং দিনকে দিন যেন সালমানের প্রতি ভক্তদের প্রেম আরো গাঢ় হচ্ছে। এমনকি সালমান শাহ-পরবর্তী সময়ে যারা চলচ্চিত্রে নায়ক হওয়ার জন্য এসেছেন তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, বলছেন- সালমান শাহ-ই ছিলেন তাদের অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস। সালমানকে দেখেই তারা নায়ক হতে এসেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, সালমানকে নিয়ে কেন এই উন্মাদনা? একজন নায়কের মৃত্যু কেনইবা এত ভাবায় সবাইকে। তার আগে ও পরে অনেক নায়কেরই তো মৃত্যু হয়েছে। কারন হলো সালমানের মতো এমন নায়ক আর আসেনি বাংলা চলচ্চিত্রে। সালমান শাহর সিনেমার ক্যারিয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের। মোট মুক্তি পেয়েছে ২৭টি সিনেমা। এর মাঝে সর্বোচ্চ ১৪টি সিনেমার নায়িকা শাবনূর। প্রথম সিনেমা কেয়ামত থেকে কেয়ামতের নায়িকা মৌসুমীর সঙ্গে করেছেন ৪টি সিনেমা। সোহানুর রহমান সোহান থেকে জাকির হোসেন রাজু মোট ২৩ জন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন।

সর্বোচ্চ তিনটি সিনেমার পরিচালক ছিলেন শিবলী সাদিক। প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছিল ভারতের ব্লকবাস্টার সিনেমার রিমেক। সে সিনেমার কাস্ট আমির খান ও জুহি চাওলাকে আমাদের দর্শকের মাথা থেকে সরিয়ে নিজেরাই এমন এক জায়গা করে নিলেন সালমান ও মৌসুমী যা এখনো একই রকম পাকাপোক্ত হয়ে আছে। তবে প্রথম সিনেমা থেকে প্রাপ্ত উপাধি চকোলেট হিরোর বৃত্ত ভেঙে ক্যারিয়ারে স্বল্প সময়েই অনেকটা এগিয়ে যান সালমান।

দ্বিতীয় সিনেমা ‘তুমি আমার’ এ মিথ্যা পরিচয়ে নিজেকে জাহির করা যুবক হোক বা ক্ল্যাসিক সুজন-সখী’র রিমেকেও দেখা গেছে তাকে। প্রেমিক, স্বামী, পিতার চরিত্রে এসেছেন কন্যাদান ছবিতে। বিক্ষোভ-এ প্রশংসিত হন ছাত্রনেতার চরিত্র। ‘একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’ নামক অসাধারন গানটি এ সিনেমারই গান। ‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমায় পরিবারের বড় বোনের আদর পেয়ে একটু দুস্ট কিন্তু দায়িত্বশীল ছোট ছেলের চরিত্র বা ‘আনন্দঅশ্রু’ সিনেমায় একটা সময় মানসিক ভারসাম্য হারানো এক যুবকের চরিত্র বা ‘মায়ের অধিকার’ সিনেমায় মায়ের অধিকার ফিরিয়ে দেবার জন্য সমাজ এবং বিত্তশালী দাদীর সাথে লড়াই অথবা ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমায় ধনী দাদির নাতি হয়ে জেলে কন্যা মৌসুমীকে ভালবেসে ঘর পালানো এক মিস্টি যুবক সব চরিত্রেই যেনো বারবার নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে গেছেন স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে।

প্রথম সিনেমা থেকেই ফ্যাশনসচেতন সালমান ধীরে ধীরে নব্বই দশকে বাংলাদেশের একমাত্র স্ট্যাইল আইকনে পরিণত হন। চোখে বাহারী সানগ্লাস, নতুন ফ্যাশনের জিনস, টি শার্ট, মাথায় স্কার্ফ ছিল তার বৈশিষ্ট্য। বলা হয়ে থাকে ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ সিনেমাটি ছিল তার ফ্যাশনের বড় বিস্ফোরণ। শেষের দিকে পনিটেল বাঁধতে শুরু করেন। মোট ২৭ সিনেমার মাঝে ১৮টি সিনেমা মুক্তি পায় সালমানের জীবদ্দশায়। বেশিরভাগ সিনেমাই ব্যবসাসফল বলে সালমান একই সঙ্গে ছিলেন প্রযোজক,পরিচালক এবং দর্শক থেকে শুরু করে প্রদর্শকদের চোখের মণি।

১৯৯৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তার ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ এই দেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে ব্যবসাসফল সিনেমার মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে। তার মৃত্যুর পর একমাত্র ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমা ছাড়া সব সিনেমাতেই তার পুরনো সিনেমার গান, সালমানের ডাবিং, খোদ সালমানের ডামি কিছু না কিছু জোড়াতালি দিতে হয়েছে নির্মাতাদের।

কথায় আছে, মানুষ মারা গেলে তিনদিনের বেশি শোক থাকে না। অমর মানুষের বেলায় এ কথা মিথ্যা। তাই ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের একটি বিষন্ন দুপুর আজ ২৪ বছর পরেও আমাদের চোখের কোণটা ভিজিয়ে দেয়, বুকটা হাহাকারে ভরে দেয়। তার মৃত্যুর খবর জানার পর আত্মহনন করেন একাধিক ভক্ত। তার বিশাল ভক্তকুল এখনো বিশ্বাস করেন তিনি আত্মহত্যা করেননি। তিনি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার।

মৃত্যুর পর সালমান এবং স্ত্রী সামিরার সম্পর্কে ভাঙনের জন্য নায়িকা শাবনূরকে দায়ী করেন অনেকেই। সালমান শাহর পরিবার কয়েকজনকে সালমানের অপমৃত্যুর জন্য দায়ী করে আসছেন। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য সালমানের স্ত্রী সামিরা, খল অভিনেতা ডন, প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাই, বিউটিশিয়ান রুবি এবং তার চাইনিজ স্বামী সহ অনেকেই। এরই মাঝে গতবছর ফেইসবুকে এক ভিডিওবার্তায় অভিযুক্ত রুবি প্রবাস থেকে বলেছেন, সালমান আত্মহত্যা করেননি।

তাকে হত্যা করা হয়েছে। দেশবাসীর সঙ্গেই নড়েচড়ে বসেছে এ সময়ে মামলার দায়িত্বে থাকা নবগঠিত পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তবে পিবিআই এর তদন্ত শেষে যে রিপোর্ট পেশ করে তাতেও আত্নহত্যাই বলা হয়েছে। এনিয়ে সালমানের পরিবার এবং তার ভক্তরা এখনো প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছেন।

বেঁচে থাকতে নানা ঝামেলায় পর্যুদস্তও ছিলেন সেই সময়ের সুপারষ্টার সালমান শাহ। বিবাহিত সালমানকে দর্শক গ্রহণ করলেও ক্রমেই তার পারিবারিক অস্থিরতা আলোচনা এবং সমালোচনায় কারন হয়। বলা হয় যে, এ কারণেই ভেঙে যায় সালমান-মৌসুমী জুটি। প্রেমের স্ক্যান্ডাল ও স্ত্রী সামিরার আপত্তিতে অনিশ্চিত ছিল সালমান-শাবনূর জুটির ভবিষ্যৎও। সত্যি বলতে সেই অস্থির সময় অন্য নায়িকাদের সঙ্গে বক্স অফিস সাফল্য আসছিলো কম। পারিবারিক অশান্তি ক্যারিয়ারেও ছাপ ফেলে, এই কারনে চলচ্চিত্রের নানা সমিতির সঙ্গেও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে একটি মন্তব্য করে আলোচিত-সমালোচিত হন।

প্রভাবশালী প্রযোজক আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে দ্বন্দের কথাও আলোচিত হয়েছিল সেই সময়। সব মিলিয়ে বিয়োগান্তক ঘটনার প্লট-সাবপ্লট সবই যেনো জড়ো হচ্ছিল চলচ্চিত্রের এই রাজপুত্রের চারপাশে। কিন্তু ভক্তদের মনে তাকে নিয়ে উন্মাদনা বেড়েই চলেছিল। আজও সেই উন্মাদনা একবিন্দু কমেনি। স্বল্পসময়ের ক্যারিয়ার হলেও এই দেশের একমাত্র সুপারস্টার অভিনেতা বলা যায় তাকে। সালমান শাহ অমর হয়ে আছেন শুধু তার সিনেমা দিয়ে, তা নয় তার ভক্ত বিস্তৃত নতুন প্রজন্মের মাঝেও।

সালমান শাহ স্মৃতি সংসদ নামে গ্রুপ আছে। ফেইসবুকেও রয়েছে একাধিক গ্রুপ। সালমানের অনুপ্রেরণায় সিনেমায় এসেছেন এই কথা স্বীকার করেন অনেক তারকা। দুঃখজনক হলেও সত্য এত জনপ্রিয় এক কিংবদন্তি নায়কের নামে এফডিসির একটি ফ্লোরের নামকরণ বা কোনো সড়কের নামকরণ করে তাকে সম্মানিত করা হয়নি। এখন তার পরিবার এবং ভক্তদের একটাই দাবী তার মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে পুলিশ, বিচার বিভাগ ও সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখাবেন এই প্রত্যাশা। তবে আমাদের কাছে সালমান শাহ এক অনুভূতির নাম আর এই অনুভূতি আমাদের মাঝে অমর হয়ে থাকবেন অনন্তকাল।

Ad