সুরসম্রাজ্ঞী লতার ৯১তম জন্মদিন

১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। দ্বীননাথ মঙ্গেশকর আর সেবন্তী মঙ্গেশকরের ঘরে এলো তাদের প্রথম সন্তান, নাম রাখলেন হেমা। দ্বীননাথের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন সেবন্তী। পণ্ডিত দ্বীননাথ নিজেও সঙ্গীত আচার্য ছিলেন। সঙ্গীত ও নাটক- দু’ক্ষেত্রেই ছিল তার সাবলীল যাতায়াত। মঞ্চনাটক লিখতেন, সাথে অভিনয়ও করতেন।

নাটকের প্রয়োজনে গানও গাইতেন। সুত্রমতে ‘ভাউবন্ধন’ নামের এক নাটক পরিচালনার পর নাটকের প্রধান চরিত্র লতিকাকে খুব মনে ধরেছিল দ্বীননাথ-সেবন্তী দম্পতীর। তাই সন্তানের নাম হেমা থেকে বদলে রাখা হলো লতা।

লতা মঙ্গেশকরের পুরো পরিবারই বলতে গেলে সঙ্গীতের রথী মহারথী ছিলেন। লতার পর একে একে সেবন্তীর কোলে আসেন আশা ভোঁসলে, উষা মঙ্গেশকর, মীনা মঙ্গেশকর ও সর্বকনিষ্ঠ হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর। ভাই-বোন বলতে পাগল ছিলেন লতা। কথিত আছে প্রতিদিন ছোট বোন আশা ভোসলেকে নিজের সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেতেন।

স্কুল কর্তৃপক্ষ নিষেধ করলে রাগ করে সেই স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দেন তিনি। এ নিয়ে আবার ভিন্ন একটি মতও আছে। স্কুলের প্রথম দিনেই নাকি শিশু লতা অন্য শিশুদের গান শেখাচ্ছিল! শিক্ষক নিষেধ করতেই ছেড়ে চলে আসেন স্কুল।

শোনা যায়, লতাকে ছোটবেলায় গান শেখানো হলেও কোনো অগ্রগতি ছিল না তার শেখায়। ওদিকে দ্বীননাথ নিজের বাসাতেই অনেক ছাত্রকে গান শেখাতেন। একদিনের ঘটনা, অল্প কিছু সময়ের জন্য বাইরে গেছেন দ্বীননাথ। এক ছাত্রকে বলে গিয়েছেন গানের অনুশীলন করতে। ফিরে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন ছোট্ট লতা তার ছাত্রের গানের রাগ শুধরে দিচ্ছে। তারপর থেকেই বাবার কাছে লতার তালিমের শুরু।

পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার লেখা মারাঠি গীতি নাটকে ছোট ছোট চরিত্রে অংশগ্রহণ করতেন লতা। একদিন দ্বীননাথের নাটকে নারদ মুনির চরিত্রের অভিনেতা কোনো কারণে এসে পৌঁছান নি। তার আবার গানও গাওয়ার কথা। লতা বাবাকে এসে বললেন, তিনি নারদের ভূমিকায় অভিনয় করতে চান। প্রথমেই দ্বীননাথ তার প্রস্তাব বাতিল করে দিলেন। ওই অতটুকু নারদ মুনিকে দেখতে যদি জোকার লাগে?

লতার পীড়াপীড়িতে শেষটায় রাজি হলেন। নাটক শেষে দর্শকদের মুখে নারদ মুনি চরিত্রে অভিনয় করা মেয়েটির প্রশংসা। তারপর থেকেই বাবার সাথে ছায়ার মতো সবখানেই যাওয়া আসা শুরু। এভাবেই কিছু স্টুডিওতে সিনেমায় ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয়।

তবে অভিনয় তার নিজের কাছে কখনোই ভালো লাগতোনা। তবে এই অভিনয়শিল্পী হিসেবেই পরিচয় হয়েছিল তখনকার কিংবদন্তি ‘নূরজাহান’ এর সাথে৷ সেখানে সেই ছোট মেয়েটির গান শুনে কন্ঠের প্রশংসা করেছিলেন সেই সময়ের জনপ্রিয় গায়িকা এবং অভিনেত্রী নূরজাহান।

তবে পিতার ছায়া খুব বেশিদিন থাকেনি লতা এবং মঙ্গেশকর পরিবারের উপর। লতার বয়স যখন মাত্র ১৩ বছর, তখন (১৯৪২ সাল) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে দ্বীননাথ মঙ্গেশকর মারা যান। ফলে সম্পূর্ণ পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে ১৩ বছর বয়সী লতার উপর। পরিবারের বন্ধু ‘নবযুগ চিত্রপট চলচ্চিত্র কোম্পানি’র মালিক মাস্টার বিনায়ক তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মঙ্গেশকর পরিবারের।

ছোটবেলায় মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন লতা। কিন্তু বিনায়ক তাকে বলেন যে কোন একটি মাধ্যমে সিরিয়াসলি কাজ করার সিদ্ধান্ত নিতে। অভিনয় ভালো লাগতোনা তাই চিকন এবং একটু পাতলা গায়কী নিয়েও গান গাইবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ১৩/১৪ বয়সী সেই মেয়েটি। তারপর তখনকার আরেক জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এবং সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন শশধর মুখার্জীর সাথে।

মুখার্জী তখন শহীদ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রটি নিয়ে কাজ করছেন। তিনি মেয়েটির গান শুনে, ‘বেশি চিকন গলা, এমন কন্ঠ প্লে-ব্যাকের জন্য নয়’ বলে বাতিল করে দিলেন। বিরক্ত রাগান্বিত হায়দার বলে বসলেন, ‘একদিন পরিচালকেরা এই মেয়ের পায়ে পড়ে তাকে তাদের চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার জন্য ভিক্ষা চাইবে।’ সেদিন কে জানত, এই ভবিষ্যৎবাণী অতি দ্রুতই সত্য হতে চলেছে।

সেই চিকন গলার মেয়েটি উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন গায়িকা হিসেবে রাজত্ব করবেন পরবর্তী কয়েকটি দশক। পরবর্তীতে ভারতের গানের পাখি বকে অভিহিত করা হয় লতা মঙ্গেশকরকে। তার গায়কীতে বিগত কয়েক দশক জুড়ে তার বিজয়ী বিচরণে বিমোহিত হয়েছে বিশ্ব।

গুলাম হায়দারের হাত ধরে তার জীবনে সুযোগ এল ‘মজবুর’ (১৯৪৮) চলচ্চিত্রে ‘দিল মেরা তোড়া, মুঝে কাহি কা না ছোড়া’ গানটি গাওয়ার। এই এক গানেই বলিউড ইন্ডাস্ট্রি নতুন এই গায়িকাকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হয়। জীবনের প্রথম বড় ধরনের হিট নিয়ে আসে ‘মহল’ (১৯৪৯) চলচ্চিত্রের ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি।

এ গানে ঠোঁট মেলালেন মধুবালা। এটি এখনো একটি অলটাইম ক্ল্যাসিক বলে অভিহিত করা হয়। ‘মহল’ সিনেমার সাফল্যের পরে একের পর এক জনপ্রিয় আর শ্রুতিমধুর গানে আপ্লুত করেছেন লাখো মানুষকে। পঞ্চাশের দশকেই গান করে ফেললেন নামীদামী সব সঙ্গীত পরিচালকদের সাথে। ষাটের দশকে উপহার দিলেন ‘পিয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া’ বা ‘আজিব দাসতা হ্যায় ইয়ে’ ‘লাগ যা গালে’ এর মতো এখনো পর্যন্ত তুমুলভাবে বিখ্যাত এবং জনপ্রিয় সব গান।

১৯৬৩ সালে ভারত-চীন যুদ্ধে লিপ্ত, জীবন বিসর্জন দিচ্ছেন সৈন্যরা। লতা গাইলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার এই গান শুনে কেঁদেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং জওহরলাল নেহরু। সত্তরের দশকে শত শত গান সৃষ্টির সাথেই কনসার্ট করেছেন দেশে-বিদেশে, তাদের অনেকগুলো আবার চ্যারিটিও। থেমে থাকেনি সময়, থেমে থাকেননি লতা।

তার এত এত সৃষ্টির ফলে অনায়াসে গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে সর্বোচ্চ সংখ্যার গান রেকর্ডকারী হিসেবে তার নাম আসে। পরে অবশ্য তার এই রেকর্ড ভেঙেছিলেন নিজেরই ছোট বোন আশা ভোঁসলে। মোট ৩৬টি ভাষায় রচিত তাঁর এই গানগুলোর অনেকগুলো ভাষা তিনি আসলে জানতেনই না। তার মধ্যে অসংখ্য বাংলা গানও আছে।

শুধু ফিল্মফেয়ার, বা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নয়, ১৯৬৯ সালে ‘পদ্মভূষণ’, ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’ আর ২০০১ সালে দ্বিতীয় ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে লতা অর্জন করেন ‘ভারত রত্ন’ খেতাব। প্রখ্যাত এই সঙ্গীতশিল্পীকে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘অফিসার দে লা দি’অনার’ প্রদান করেছে সে দেশের সরকার।

মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তার তাকে জানান তার খাবারে অল্প করে বিষ মেশানো হচ্ছে। বাড়ি ফিরে দেখেন তার রাধুনি পালিয়ে গেছে। তাই এই ঘটনার এখানেই সমাপ্তি হয় তবে এরপর থেকে আরো সাবধানের সাথে কাজের লোক নিয়োগ দেয়া হয় তার জন্য। শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তার। বাবা চাইতেন লতা শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক।

জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাকে শুনতে হয় তা হচ্ছে, কে. এল. সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি। এই থেকেই লতার অভিমান এবং জেদ সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়। শিল্পীদের গানের রাইট নিয়ে আন্দোলন করেছেন তিনি।

কপিরাইট ব্যবহার করে শুধু প্রযোজক রাই লাভবান হবেন তা মেনে নিতে পারেননি তিনি। এই নিয়ে তার সবচেয়ে বেশি ডুয়েটের সহশিল্পী মোহাম্মদ রফীর সাথে রাগ করে একবছর কথা বলেননি তিনি। সেই সময়ের সুপারহিট প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনেতা রাজ কাপুরের সাথেও তার মনোমালিন্য হয়েছিল। তবে একটা সময় শিল্পীরাও রাইট পাওয়া শুরু করলে এসব দ্বন্দ্বের অবসান হয়।

মোহাম্মদ রফী, মান্নাদে, কিশোর কুমার এই তিনজন জনপ্রিয় গায়কের সাথে জুটি বেধে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য কালজয়ী গান। যা আজো একই রকম জনপ্রিয়। মধুবালা, নার্গিস, সাধনা, মীনা কুমারী, ওয়াহিদা রহমান, জয়া বচ্চন, রেখা, হেমা মালিনী, শ্রীদেবী, মাধুরী, কাজল, কারিশমা, রানী, প্রীতি জিন্টা, ঐশ্বরিয়া সহ পাচ দশকের প্রায় সব জনপ্রিয় নায়িকা তার গাওয়া গানে লিপসিং করেছেন।

এমন রেকর্ড করা গায়িকাই কয়জন আছেন এই বিশ্বে! যখন সময় ছিল তখন বড় একটি পরিবারের দায়িত্বের কারনে বিয়ে করেননি। পরবর্তীতে প্রেম নিয়ে কিছু গুঞ্জন থাকলেও সেসব কোনোটাই সত্যি বলে প্রমানিত হয়নি। একা একাই কাটিয়ে দিয়েছেন সারাটি জীবন শুধুমাত্র পরিবার এবং সংগীতকে ভালোবেসে।

গতবছর তাঁর নব্বই বছর পূর্ণ হবার সন্ধিক্ষনে একটি মারাঠী গানে কন্ঠ দেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দেন এটিই তার গাওয়া শেষ গান। লতা হয়তো তার শেষ গানটি গেয়ে ফেলেছেন, কিন্তু লতার কালজয়ী সব সৃষ্টির রেশ রইবে চিরকাল।

Ad