৫৬ বছরে ‘গুরু’ জেমস

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : জাতি হিসেবে ব্রিটিশদের আছে একজন কাল্পনিক জেমস বন্ড, আমাদের আছেন রক্ত-মাংসের কিংবদন্তি গায়ক জেমস। তার পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম। তবে তিনি বাংলাদেশের সংগীতপ্রেমীদের কাছে ‘গুরু’ নামেই পরিচিত। অসাধারন গায়কী দিয়ে একজন রকস্টার থেকে তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘গুরু’তে পরিণত হয়েছেন তিনি।

জেমসের এই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা কিন্তু এই সময়ের মিডিয়া বা ব্র্যান্ড প্রমোশনের মাধ্যমে তৈরী হয়নি। তাঁর সঙ্গে ভক্তদের যোগাযোগ ছিল সরাসরি গানের মাধ্যমে। তাই জনপ্রিয়তাও নির্ভেজাল। অবশ্য শুধু জেমস নয় আশি,নব্বই বা শূন্য দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিনোদনের সব মাধ্যমের জনপ্রিয় প্রায় সকল তারকার জনপ্রিয়তা ছিলো তাদের কাজের মধ্য দিয়েই।

আজ ২রা অক্টোবর আমাদের জেমসের জন্মদিন। আজ ৫৬ বছরে পা দিচ্ছেন সংগীত ভূবনের এই মহাতারকা। লম্বা কোঁকড়ানো চুল নিয়ে গিটার হাতে যখন মানুষটা মঞ্চে উঠেন তখন যে উন্মাদনা বা ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করা যায় তা কতোটা নির্ভেজাল আর বাস্তব এটা বুঝতে বাকি থাকেনা কারো।

বাংলাদেশের একদম পুরোনো থেকে উঠতি যত ব্যান্ড আছে এদের মাঝে জেমস যেন এখনো এক অনন্য উচ্চতায়। জেমসের গান আমাদের হাসায়, কাঁদায় আবার নতুন করে অনেক কিছু ভাবতে শেখায়। এটাই হয়তো শিল্পী হিসেবে জেমসের স্বার্থকতা এবং শ্রোতা হিসেবে আমাদের প্রাপ্তি।

বলা হয়ে থাকে নব্বইয়ের দশক ছিল মূলত কনসার্ট ও ব্যান্ড কালচারের জন্য স্বর্ণযুগ। যার রেশ শূন্য দশকের মাঝামাঝি সময়েও দেখা গিয়েছে। ক্যাসেট কেনার পাশাপাশি আরেকটি ভালো লাগার বিষয় ছিলো কনসার্ট। সেই সময় প্রতি সপ্তাহেই কোথাও না কোথাও কনসার্ট হতো।

ঢাকার আর্মি স্টেডিয়াম, ঢাকা কলেজ, টিএসসি, ধানমণ্ডি উইমেন্স কমপ্লেক্স, কলাবাগান মাঠ, আবাহনী মাঠ এসব জায়গায় নিয়মিত গানের এসব কনসার্ট আয়োজন করা হতো। আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, হাসান, বিপ্লব এসব নামের জোরেই কনসার্টে এমন ভীড় হতো যা সামলানো মুশকিল হয়ে যেতো।

সুস্থধারার সেই সংস্কৃতি চর্চা আমাদের তৃপ্তি দিতো। যদিও এই নামগুলোর মাঝে এখন শুধুমাত্র জেমসই তার পথচলা অব্যাহত রেখেছে। এখনো শহুরে সন্ধ্যার আড্ডা থেকে শুরু করে গ্রামের হাটে-বাজারে বাজে তার গান। এই লম্বা সময় ধরে জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতি ধরে রাখা কম আশ্চর্যের নয়।

নওগাঁতে জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা চট্রগ্রামে। সরকারি কর্মকর্তা বাবার সাথে গান গাওয়া নিয়ে মনোমালিন্য থেকে রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে আজিজ বোর্ডিং থেকে শুরু করে এখন ঢাকায় বারিধারায় আলিশান ফ্ল্যাট। মাঝে ৪০ বছরের লম্বা সময় ধরে শুধুমাত্র সংগীত নিয়ে পথচলা। জেমসের শুরুটা ১৯৮৬ সালে ফিলিংস নামের ব্যান্ডের ‘স্টেশন রোড’ দিয়ে।

এরপর ‘জেল থেকে বলছি’ (১৯৯৩), ‘নগর বাউল’ (১৯৯৬), ‘লেইস ফিতা লেইস’ (১৯৯৮) এবং ২০০০ সালে নগর বাউল ব্যান্ড গঠন করে প্রকাশ করেন ‘দুষ্টু ছেলের দল’ (২০০১) অ্যালবামটি। ব্যান্ডের পাশাপাশি একক, মিশ্র অ্যালবাম ও প্লেব্যাকে উপহার দেন অজস্র জনপ্রিয় গান।

জেমসের একক অ্যালবামগুলোও পেয়েছে অসামান্য জনপ্রিয়তা। ‘অনন্যা’ (১৯৮৮), ‘পালাবে কোথায়’ (১৯৯৫), ‘দুঃখিনী দুঃখ করোনা’ (১৯৯৭), ‘ঠিক আছে বন্ধু’ (১৯৯৯), ‘আমি তোমাদেরই লোক’ (২০০৩), ‘জনতা এক্সপ্রেস’ (২০০৫), ‘তুফান’ (২০০৬) এবং ‘কাল যমুনা’ (২০০৮) প্রতিটা অ্যালবামই জনপ্রিয়তার রেকর্ড ভেঙে গেছে একের পর এক। যতোদিন গিয়েছে জেমস যেনো আরো পরিনত এক গায়ক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

বাংলাদেশ, জেল থেকে আমি বলছি, মা, দুখিনী দুঃখ করো না, লেইস ফিতা লেইস, বাবা কতো দিন, বিজলী, দুষ্টু ছেলের দল, মিরাবাঈ, পাগলা হাওয়া, গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন তিনি। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অংগনেও নিজের প্রতিভার উদাহরন রাখার পাশাপাশি জনপ্রিয়তাও লাভ করেছেন তিনি।

বলিউডের কিছু সিনেমার জন্য তার গাওয়া গানগুলো কালজয়ী গান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। বলিউডে জেমসের গানের মধ্যে রয়েছে ‘ভিগি ভিগি (গ্যাংস্টার)’, ‘চল চলে (ও লামহে)’, ‘আলবিদা (রিপ্রাইস)’, ‘রিশতে (লাইফ ইন এ মেন্ট্রো)’, ‘বেবাসি (ওয়ার্নিং থ্রিডি)’ উল্লেখযোগ্য৷

আমাদের দেশের সিনেমায় কম গান গাইলেও প্রথমবার ‘দেশা দ্য লিডার’ সিনেমার জন্য গান গেয়ে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। বিরতি দিয়ে ২০১৭ সালে ‘সত্ত’ সিনেমায় তার গাওয়া ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং সেই বছর গায়ক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করেন তিনি।

এছাড়া মেরিল প্রথম আলো, বাচসাস সহ অসংখ্য পুরস্কার জয় করেছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার তিনি যেটা পেয়েছেন সেটা হলো ভক্তদের অকৃত্রিম ভালোবাসা।

একটা প্রজন্মের কাছে জেমস মানে এখনো এক উন্মাদনা, তার প্রতি ভক্তদের ভালোবাসা এতোটাই প্রবল যে ভক্তদের তিনি ‘দুষ্টু ছেলের দল’ বলে অ্যাখ্যায়িত করেন। তাইতো তার জন্মদিনে ২০১৫ সালে ঢাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার ধারে বিশাল আকারের ১২টি বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়।

আবার পরের বছর জেমসের জন্মদিনে দেড় হাজার কেজি ওজনের কেক তৈরি করেন এক ভক্ত। ২০০০ সালে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ভক্তদের উদ্যোগে একটি সড়কের নাম দেওয়া হয় ‘জেমস রোড’। এই ভালোবাসা বা এই শ্রদ্ধা কি একদিনেই অর্জন সম্ভব হয়েছে!! উত্তর হচ্ছে- না। ভক্তদের এমন সরল আর নির্ভেজাল ভালোবাসার নজির খুব একটা চোখে পড়েনা।

তার গান এবং গায়কীর মুন্সিয়ানায় কখনো কনডেম সেলে ফাঁসির আসামীর মৃত্যুর দিন গোনার হাহাকার আমরা শুনেছি তেমনি আবার বিরহে কাতর প্রেমিকের আর্তনাদ অনুভব করেছি। তার গায়কীতে বাবা-মায়ের প্রতি ভালোবাসা নতুন করে জানতে পেরেছি আবার ‘বাংলাদেশ’ গানের মাধ্যমে আমাদের বাংলা এবং বাঙ্গালি সত্তা নতুন করে জাগ্রত হয়েছে। জন্মদিনে শুভ কামনা রইলো ‘গুরু’র জন্য। তার গান আমাদের বিমোহিত করে রাখুক অনন্তকাল এটাই কামনা।

Ad