সমাজের বাস্তব চিত্র নিয়ে ‘আড়াই মন স্বপ্ন’

বর্তমানে আমাদের এখানে গতানুগতিকের বাইরে কাজ হয় খুব কম। তবে যেসব কাজ হয় সেগুলো নান্দনিক কাজ হিসেবে দর্শকদের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করে নেয়। এই ‘বাঘ বন্দি সিংহ বন্দি’ সিরিজের ‘আড়াই মন স্বপ্ন’ নামের শর্টফিল্মটি তেমনই একটি কাজ।

বিগত সাত-আট মাসের অজানা অচেনা এক বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে পরিচালক করেছেন আবু শাহেদ ইমন অসাধারন একটি কাজ উপহার দিয়েছেন আমাদের। আমি কোনো রিভিউ বা আলোচনা-সমালোচনা করছিনা। কারন রিভিউ দেবার মতো ততোটা যোগ্যতা এখনো আমার নাই। তবে একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে এই কাজটি কেমন লেগেছে সেটাই বলার-লেখার চেস্টা করলাম এই পোষ্টের মাধ্যমে।

করোনায় থমকে যাওয়া পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থান, শারীরিক ও মানসিক বির্পযয় সহ নানা অভিজ্ঞতা পাঁচটি ভিন্নধর্মী গল্পের মাধ্যমে একটি সিরিজে তুলে ধরা হয়েছে। আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নির্মাতা প্রায় ৩০ মিনিট দৈর্ঘ্যের এ গল্পগুলো আমাদের সামনে হাজির করেছেন নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং চিন্তায় ভর করে।

করোনাকালে মানুষের জীবনের নানা রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে পাঁচ পর্বের এই এন্থলজি সিরিজের নাম ‘বাঘ বন্দি সিংহ বন্দি’। এই সময়ের বিনোদনের অন্যতম জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ওটিটি। আমাদের দেশের আলোচিত ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘বিঞ্জ’ এ এই সিরিজটি দেখতে পাওয়া যাবে। এই পাঁচটির মধ্যে একটি গল্প হচ্ছে ‘আড়াই মন স্বপ্ন’।

‘আড়াই মন স্বপ্ন’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি এই করোনা সংকট চলাকালে সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের চরম আর্থিক সংকটকে তুলে ধরেছে এক অনবদ্য নির্মানের মাধ্যমে। এরই সাথে আমাদের দেশের নানা রকম সামাজিক অনিয়ম, লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহার দেশের নিম্নবিত্তের অসহায়ত্ব কতোটা বাড়িয়েছে সেটি এই চলচ্চিত্রে সুন্দর ভাবে উঠে এসেছে। এখানে যা যা দেখানো হয়েছে এসব কিছুই কিন্তু আমরা করোনার সময়ে টেলিভিশন, নিউজ পেপারের মাধ্যমে জেনেছি এবং দেখেছি তাই গল্পের সাথে রিলেট করতে আমাদের সমস্যা হয়নি। কারন বাস্তব সত্য নিয়েই এই ‘আড়াই মন স্বপ্ন’।

অভাব-অনটনের কারনে শহর ছেড়ে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের গ্রামে ফিরে যাবার কাহিনি নিয়েই ‘আড়াই মন স্বপ্ন’। ব্যতিক্রমী কিন্তু সমসাময়িক বাস্তব তাই কন্টেন্ট বা গল্পটি ভালো লেগেছে। পরিচালক আবু শাহেদ ইমন অবশ্যই প্রশংসা পাবেন এমন সেনসিটিভ ইস্যু কখনো নির্মল হাস্যরস আবার কখনো একেবারে সহজ এবং সাবলীলতার মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। ৩৫ মিনিট ব্যাপি এই ‘আড়াই মন স্বপ্ন’ পুরাই পয়সা উসুল একটি ফিকশন।

না সেই হিসেবে টেলিভিশনের এই সময়ের জনপ্রিয় কোনো তারকা শিল্পী এই ফিকশনে নাই। তবে যারা আছেন তারা যে কতোটা দক্ষ এবং শক্তিশালী তা নতুন করে বলার কিছু নাই। প্রথমেই বলি-লিখি আমাদের দেশের এই সময়ের অন্যতম সেরা শক্তিশালী অভিনেতা ফজলুর রহমান বাবুর কথা। এই মানুষটাকে নিয়ে নতুন করে কিছু আসলে লিখার নাই। কারন একজন প্রকৃত অভিনয় শিল্পী তিনি।

দিলদার আলী চরিত্রে এতো সাবলীল এবং প্রানবন্ত অভিনয় করেছেন তিনি যা মুগ্ধতা ছড়াবেই। ত্রানের জন্য ল্যাংড়া হয়ে হাটার অভ্যাস করার দৃশ্যে হোক বা চোখ ট্যারা করা অথবা নিজের নিখোজ বাবার নামে রেশনের কার্ড নেয়ার দৃশ্যে হোক তিনি অনবদ্য ছিলেন। অন্যদিকে নিজের সন্তানের জন্য খেলনা কিনে হাজির হওয়া একজন বাবা যে কিনা তার সন্তানের মৃত্যুতে অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়েন সেই নরম হৃদয়ের বাবার চরিত্রেও অসাধারন ছিলেন তিনি।

অবাক হই মৌটুসী বিশ্বাসের মতো একজন মেধাবী অভিনেত্রী আমাদের দেশে তেমন কাজ করার সুযোগ পায়না। কারন ভিউয়ার দিয়ে জনপ্রিয়তা পরিমাপের এই যুগে নান্দনিক কাজের গ্রহনযোগ্যতা কম তাই হয়তো মৌটুসী বিশ্বাসের মতো নান্দনিক অভিনেত্রীরা একটা সময় হারিয়ে যান।

‘আড়াই মন স্বপ্ন’ তে যতোটুকু সময় তিনি স্ক্রিনে ছিলেন তার অভিনয়, চাহনী, ডায়লগ তাকে নিম্নবিত্ত পরিবারের একজন সাধারন স্ত্রী রাবেয়া এবং একজন মমতাময়ী মায়ের বাইরে অন্যকোন কিছু ভাবার চান্স দিবেনা। এটাই একজন অভিনেত্রীর স্বার্থকতা। খুব খুশি হবো যদি মৌটুসী বিশ্বাসের মতো আন্ডাররেটেড অভিনেত্রীদের নিয়ে আমাদের গল্পকার, পরিচালকরা একটু নতুন করে ভাবেন।

‘আড়াই মন স্বপ্ন’র আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরেক গুনী অভিনেতা রওনক হাসান। ব্যক্তিগত ভাবে খুব পছন্দের এই অভিনেতা এই ফিকশনেও ছিলেন অসাধারন। একজন দূর্নীতিবাজ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বারের ভূমিকায় তিনি মানিয়ে গেছেন সফলতার সাথে।

করোনাকালে মাস্ক কখনো কানে কখনো থুতনিতে নিয়ে তার ডায়লগ ডেলিভারি এবং দক্ষ অভিনয় প্রশংসার যোগ্য। তবে আক্ষেপ হলো এই গুনী অভিনেতা তার যোগ্যতা অনুযায়ী চরিত্র পাননা। আমাদের নির্মাতারা কেনো এমন চমৎকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কাজে লাগান না তা একমাত্র হয়তো তারাই জানেন।

ইউটিউবের মতো ফ্রি নয়, ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘বিঞ্জ’ এর কনটেন্ট টাকা খরচ করে দেখতে হয়। তবে টাকার পরিমান কিন্তু খুব অল্প। ভালো কাজ হয়না, ভিন্নধর্মী কনটেন্ট নিয়ে কাজ হচ্ছেনা বলে যারা গলা ফাটান তারা এসব কাজ দেখতে পারেন অল্প কিছু টাকা খরচ করে।

কারন আমরা যদি ভালো কাজ না দেখি বা এরকম সময়ে যারা স্রোতের বাইরে যেয়ে ব্যতিক্রমী কাজ নিয়ে হাজির হচ্ছেন তাদের কাজটাকে উৎসাহ না দেই তাহলে সামনে কিভাবে তারা রিস্ক নিবেন। তাই নিজের দেশের নিজের শিল্পীদের নান্দনিক কাজগুলো দেখি এবং এই মাধ্যমটাকে এগিয়ে নিয়ে যাই এটাই কামনা।

Ad