চলচ্চিত্রে নতুন সুবাতাস নিয়ে বর্ষণ

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : সিনেমার ব্যতিক্রমী নাম, পোস্টার, টিজার, ট্রেলার ও গান রিলিজ এবং করোনা পরিস্থিতি সহ বিভিন্ন কারনে মুক্তির তারিখ বেশ কয়েকবার পিছিয়ে দেবার পরে মাসুদ হাসান উজ্জ্বলের প্রথম সিনেমা ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’র রিলিজ পায় গত ২৩শে অক্টোবর।

শুধুমাত্র স্টার সিনেপ্লেক্সের শাখাগুলোতে মুক্তির পরেও ভিন্নধর্মী এই সিনেমা দর্শকদের কাছ থেকে প্রশংসা পাচ্ছে। এই আধুনিক সময়ে এসেও অন্যরকম এক ভালোবাসার সম্পর্ক সাথে আস্থার গল্প নিয়ে ক্যারিয়ারের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন টেলিভিশনের আলোচিত নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল।

‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সিনেমার গল্পের মূল চরিত্র অয়ন এবং নীরা। এই দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ ও শার্লিন ফারজানা। আমাদের দেশের তথাকথিত বানিজ্যিক সিনেমার গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে একেবারেই ভিন্নধর্মী সিনেমাটি রিলিজ হবার পর থেকেই দর্শকদের কাছে অন্যরকম এক আগ্রহ এবং ভালোলাগার মূহুর্ত নিয়ে এসেছে।

ট্রেলার রিলিজের পর সিনেমার গল্প ঘিরে সিনেমাপ্রমীদের মধ্যে আগে থেকেই যে আগ্রহ ছিলো সেটা পুরো সিনেমা দেখার পরে আরো বেশি আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। অবশ্য নির্মাতা উজ্জ্বল আগেই জানিয়েছিলেন যে, এটা কাঁচের যুগের সিনেমা নয়। ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ একটি অন্যরকম অনুভূতির সিনেমা। আর এই অনুভূতির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সিনেমার অয়ন মানে নবীন অভিনেতা ইমতিয়াজ বর্ষণ। আজ এই নতুন কিন্তু দক্ষ অভিনেতাকে নিয়েই এই বিশেষ ফিচার।

চট্টগ্রামের ছেলে ইমতিয়াজ বর্ষণ ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সিনেমার আগে ওয়াহিদ তারেকের ‘আলাগা নোঙর’, এন রাশেদ চৌধুরীর ‘চন্দ্রাবতীর কথা’ ও অঞ্জন সরকার জিমির ‘ক্ষত’তে অভিনয় করেছেন। যদিও এর মধ্যে কোনো সিনেমাই এখন পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। সেই হিসেবে তার অভিনীত চতুর্থ সিনেমা ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ দিয়েই রুপালী পর্দায় অভিষেক হয়েছে তার।

হল কমে যাওয়া, মধ্যবিত্তদের হল বিমুখ হওয়া, দক্ষ শিল্পী সংকট, ইন্ডাস্ট্রির মাঝে কিছু সংগঠনের দলাদলি এবং সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি সহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি এক কঠিন সময় পার করছে তার মধ্যেও খুব কম সংখ্যক হলে রিলিজ পাবার পরেও প্রথম সিনেমা দিয়েই নজর কেড়েছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। যদিও একটি সিনেমা দিয়েই সম্ভাবনাময় বা আলোচিত অভিনেতা এসব বিশেষন নামের আগে যুক্ত করাটা উচিত নয় তবুও অভিনেতা হিসেবে আলাদা একটা ঝলক দেখিয়েছেন তিনি সেটা বলাই যায়।

বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যমে একটি সিনেমার প্রধান অভিনেতা হিসেবে নিজের চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার শুরু করার পর স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত তিনি। এবং খুশির বিষয় হচ্ছে দেশের কিছু খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে সাথে সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি।

পর্দায় সাধারন একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ যে কিনা কাজের পাশাপাশি পরোপকারে নিয়োজিত এই সময়ের এক আধুনিক তরুন সেই অয়ন চরিত্রে খুব ভালোভাবেই মানিয়ে গেছেন বর্ষণ। রোমান্টিক ঘরানার এই গল্পে পুরো সিনেমায় তার শান্ত এবং একটু চুপচাপ টাইপ এক যুবকের চরিত্রে নিজের সেরাটাই দিয়েছেন।

এবং বাড়তি পাওনা হলো তার ভয়েস। অসাধারন কন্ঠ দিয়েও অয়নের চরিত্রে সহজাত অভিনয়ের দক্ষতা ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। ঢাকার সিনেমায় সম্ভাবনাময় এই অভিনেতাকে আমাদের নির্মাতারা কতোটুকু কাজে লাগায় সেটাই এখন দেখার বিষয়।

ব্যক্তিগত জীবনে চট্টগ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস এবং একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করার কারনে ঢাকায় আসা যাবার ব্যাপারে একটা প্রতিবন্ধকতা ছিলো। তবে অভিনেতা হবার ইচ্ছা এবং কাজের প্রতি ভালোবাসা তাকে এই জায়গায় এনেছে এটা বলা যায় নিঃসন্দেহে। এই সিনেমায় তার চুক্তিবদ্ধ হবার বিষয়টিও মজার।

একদিন হঠাৎ করেই পরিচালক মাসুদ হাসান উজ্জ্বল তাকে দেখা করতে বলেন। পরিচালকের অফিসে দেখা করতে গেলে কিছু পৃষ্ঠা ধরিয়ে দিয়ে পড়তে বলেন বর্ষণ সেগুলো পড়েন। এক পর্যায়ে সিনেমার ব্যাপারে সব বলে তাকে পরে জানানো হবে বলে সেদিনের মতো বিদায় নেন পরিচালক।

কিছুপর মাসুদ হাসান উজ্জ্বল আবার জানান যে, ‘বর্ষণকে আসতে হবে তার অফিসে? এরপর এক শুক্রবার তিনি নির্মাতার অফিসে গেলেন। তখন আবার তার স্ক্রিন টেষ্ট নেওয়া হলো। তারপর আবার বেশ কিছুদিন যোগাযোগ নেই। আশার আলো যেমন ক্ষীণকায় হয়ে যায়, বর্ষণের অবস্থা ঠিক তেমনই হয়েছিল। কিন্তু না, তার কয়েকদিন পরই তাকে ফোন দিয়ে জানানো হলো- ঢাকায় আসতে হবে।

আনুষ্ঠানিকভাবে সিনেমাটিতে চুক্তিবদ্ধও হতে হবে। এরপর টানা তিন মাস চলে রিহার্সেল। প্রতি শুক্রবার আর শনিবার ঢাকায় এসে রিহার্সাল করেন তিনি। এভাবেই সিনেমাটির কাজ শেষ করেছেন বর্ষণ। এবং সিনেমা মুক্তির সময়ে প্রমোশন এবং অন্যান্য নানা দিক বিবেচনা করে প্রাইভেট চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। এতোদিনের সেই কষ্ট এবং পরিশ্রমের ফসল ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ এবার বড় পর্দায়।

তাই আনন্দ এবং অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলেই জানান তিনি। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা মুক্তির পর অনুভূতি ব্যক্ত করতে যেয়ে বর্ষণ জানান, আমার ডিরেক্টর উজ্জ্বল ভাই আমাদের এক্টিং নিয়ে সন্তুষ্ট। উনার কাছ থেকে পাওয়া কমেন্ট আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। উনার নির্দেশ মেনে এক্টিং করার চেষ্টা করেছি। এটা অভিনেতা হিসেবে আমার জন্য অনেক বড় একটা প্রাপ্তি। বাকিটা দর্শক ভালো বলতে পারবে।

তবে উজ্জ্বল ভাইয়ের কাছে আমি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ আমাকে সুযোগ দেবার জন্য। আমার গুরু অসীম দা আমার সিনেমা দেখে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আশির্বাদ করেছেন এটাও আমার জন্য অনেক বড় একটা প্রাপ্তি। এছাড়া শার্লিন এর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ আমি, ও অনেক সাপোর্ট করেছে আমায়। ওর সহযোগিতা না পেলে অয়নকে জীবন্ত করে তুলে ধরা অনেক বেশি কষ্টকর ব্যাপার হতো।

উল্লেখ্য, পরিচালনার পাশাপাশি ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সিনেমার কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য, শিল্প নির্দেশনা এবং সংগীত পরিচালনাও করেছেন মাসুদ হাসান উজ্জ্বল। শুধু তাই নয়, ফটোগ্রাফি এবং পোস্টার ডিজাইন সবই তার নিজের করা। ২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সিনেমায় আছে মোট ৫টি গান। যার একটি গান করেছেন দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ডদল অর্থহীনের প্রতিষ্ঠাতা ও দলনেতা সাইদুস সালেহীন খালেদ সুমন।

গত মাসের ২৩ তারিখে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ এই সপ্তাহে এসে স্টার সিনেপ্লেক্সের ৩টি শাখা, ব্লক বাস্টার সিনেমা, নারায়ণগঞ্জের সিনেমাস্কোপ, চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিন এবং সুগন্ধা, এবং খুলনার লিবার্টি প্রেক্ষাগৃহে সগৌরবে চলছে সিনেমাটি। করোনা পরিস্থিতিতেও ঝুকি নিয়ে সিনেমাটি মুক্তি দেবার সাহস দেখিয়েছেন নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বল।

দর্শকদের হলে ফিরিয়ে আনার, গতানুগতিক ধারা থেকে বের হয়ে নতুন একটি গল্প আমাদের উপহার দেবার উপলক্ষ হিসেবে সিনেমার নির্মাতা সহ পুরো টিমের জন্য রইলো অভিনন্দন এবং শুভকামনা। এই পথচলা বাংলাদেশী সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য নতুন আলো নিয়ে আসবে এটাই কামনা।

Ad