তিনি আমাদের চম্পা

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির তিনকন্যা খ্যাত সুচন্দা ববিতা এবং চম্পা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সময়ে তাদের অভিনয় দক্ষতা, সৌন্দর্য্য এবং ফ্যাশন সেন্স দিয়ে সাধারণ দর্শকদের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন। তিন বোনের ছোটবোন হলেন চম্পা। পুরো নাম গুলশান আরা চম্পা।

মজার ব্যাপার হচ্ছে চলচ্চিত্রে নিজের আপন দুই বড় বোনের সফলতা এবং জনপ্রিয়তা দেখার পরেও দুই বোনের পথ ধরে কোনদিনও অভিনয় করতে চাননি তিনি। তবে নিয়তিতে ছিলো অভিনেত্রী হিসেবে মানুষের ভালোবাসা পাবেন সেটিই সত্যি হয় একটা সময়ে। দেশের অন্যতম সেরা দক্ষ এবং জনপ্রিয় অভিনেত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে তাকে নিয়ে এই বিশেষ ফিচার।

ষাটের দশকে যশোর শহরে পৈতৃক বাড়ি রাবেয়া মঞ্জিলে চম্পার জন্ম। বাবা নিজামুদ্দীন আতাউব একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন এবং মা বি. জে. আরা ছিলেন একজন চিকিৎসক। ছোটবেলা থেকেই চঞ্চল এবং দুষ্ট ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ঢাকার গেন্ডারিয়াতে স্থায়ী হন পরিবারের সাথে। ১৯৮২ সালে প্রখ্যাত ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম খানের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এই দম্পতির একমাত্র কন্যা এষা।

মিডিয়া জগতে চম্পার আগমন ঘটেছিলো মডেল হিসেবে, সেই সময়ে নারী মডেল হিসেবে বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন তিনি। লাক্স এবং বৌরানী প্রিন্ট শাড়ির বিজ্ঞাপন তাকে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলো। সেই জনপ্রিয়তার রেশ ধরেই ডাক পান টিভি নাটকে। ১৯৮১ সালে বিটিভিতে আবদুল্লাহ আল মামুন রচিত ও প্রযোজিত ‘ডুব সাঁতার’ নামে একটি নাটকের মধ্য দিয়ে তার অভিনয় জীবনের শুরু।

এরপর একে একে তিনি অভিনয় করেন ‘অপয়া’, ‘এখানে নোঙর’, ‘শাহাজাদির কালো নেকাব’, ‘খোলা দরজা’, ‘একটি যুদ্ধ অন্য একটি মেয়ে’, ‘আকাশ বাড়িয়ে দাও’ সহ আরো অনেক জনপ্রিয় নাটকে। টেলিভিশনে ব্যাপক প্রশংসা এবং জনপ্রিয়তা পেলেও সিনেমায় অভিনয় করার কোনো ইচ্ছা তার ছিলো না।

পরবর্তীতে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যমে অন্তত একটি সিনেমায় তিন বোন একত্রে কাজ করবেন এই চিন্তা থেকেই বিয়ের পরে স্বামীর অনুমতি নিয়ে বড় বোন সুচন্দার আগ্রহে চলচ্চিত্রে চম্পার অভিষেক ১৯৮৬ সালে। পরিচালক শিবলী সাদিকের ‘তিন কন্যা’ সিনেমার মাধ্যমে প্রথম সিনেমাতেই নজর কাড়েন তিনি। তারা তিন বোনই (সুচন্দা ববিতা চম্পা) তাদের সত্যিকার নামেই এই সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন।

বানিজ্যিক ধারার এই সিনেমায় একজন পুলিশ ইনসপেক্টরের ভূমিকায় চম্পার অভিনয় পরিচালক এবং প্রযোজকদের কাছে সম্ভাবনাময় তারকা হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। এরপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার। একের পর এক বাণিজ্যিক সিনেমাতে চম্পা’র অভিনয় এবং লুক তাকে ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম ব্যস্ত এবং জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। রোমান্টিক, সামাজিক, অ্যাকশন, ফোক সহ প্রায় সব ধরনের সিনেমাতে তিনি সফলতা পান।

নিষ্পাপ, সহযাত্রী, ত্যাগ, গর্জন,ছেলে কার, অবুঝ হৃদয়, কাশেম মালার প্রেম, ভেজা চোখ, ঘৃনা, প্রেম লড়াই, জন্মদাতা, প্রেম দিওয়ানা, টপ রংবাজ, ডিসকো ড্যান্সার, দেশপ্রেমিক, বিশাল আক্রমণ, গোলাপী এখন ঢাকায়, শেষ সংগ্রাম, শেষ খেলা’ র মতো বানিজ্যিক সফল ও আলোচিত সিনেমাগুলো তাকে তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তারকা নায়িকা হিসেবে যে খেতাব তিনি পান সেটি বহাল থাকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এরপরের যাত্রাটা একজন বানিজ্যিক ঘরানার সফল নায়িকা থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সফল গল্প।

কলকাতার চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান নির্মাতা গৌতম ঘোষের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ সিনেমার মালা চরিত্রটি তাকে অভিনেত্রী হিসেবে আলাদা একটা জায়গায় নিয়ে যায়। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চেও সফলতা এবং প্রশংসা লাভ করেন চম্পা। ক্যারিয়ারের সেই সফল সময়ে বানিজ্যিক সিনেমার পাশাপাশি ভিন্নধর্মী সিনেমার ঘরানায় কাজ করাটা রিস্কি ছিলো তবে চম্পা জানতেন অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং কঠিন পরিশ্রম তাকে দর্শকদের ভালোবাসা এনে দিবে।

এই সিনেমাতে অসাধারন অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ চম্পা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এই সিনেমা দিয়েই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে আরো কাজ করার সুযোগ পান তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায় ‘টার্গেট’ সিনেমাতে চম্পাকে নির্বাচন করেন মূল নারী চরিত্রে। আরেক খ্যাতিমান নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ‘লাল দরজা’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য তাকে চুক্তিবদ্ধ করেন।

এই সিনেমার পরিচালক ছিলেন বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত এবং প্রযোজক ছিলেন কিংবদন্তি সুরকার এবং গায়ক বাপ্পি লাহড়ী। পরবর্তীতে ভিন্নধারার জনপ্রিয় নির্মাতা গৌতম ঘোষের পরিচালনায় আবারো হাজির হন তিনি ‘আবার আরণ্যে’ সিনেমাতে। এই সিনেমায় তিনি অভিনয়ের সুযোগ পান সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, টাবু র মতো খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীদের সাথে। একই পরিচালকের ‘মনের মানুষ’ সিনেমাতে চম্পার অভিনয় তাকে একটি আলাদা স্থানে নিয়ে যায়।

কলকাতার পাশাপাশি তখন আমাদের দেশেও ব্যতিক্রমী গল্প এবং চরিত্র নির্ভর সিনেমাতেও তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। ‘শঙ্খনীল কারাগার’, ‘শাস্তি’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘একখন্ড জমি’, ‘উত্তরের ক্ষেপ’ এর মতো নান্দনিক সিনেমায় তার অভিনয় আমাদের মুগ্ধ করেছে। আশির দশকেই দেশীয় চলচ্চিত্রে শুধু অভিনয় দক্ষতা এবং ফ্যাশন সেন্স দিয়েই তিনি ভেঙেছিলেন অনেক সময় ধরে চলে আসা কিছু রীতি।

যেমন টেলিভিশনের তারকার সিনেমাতে সফল হননা, বা বিবাহিত নায়িকাদের দর্শকেরা গ্রহন করেন না। এমন প্রচলিত ধারনা ভেঙেছেন যে কয়জন অভিনেত্রী তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নাম চম্পা। বিয়ের পরেই তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেছিলেন। রাজ্জাক, আলমগীর, জাফর ইকবাল এর মতো খ্যাতিমান অভিনেতাদের সাথে কাজ করেছেন তিনি।

তবে জুটি হিসেবে ইলিয়াস কাঞ্চন এবং মান্নার সাথে অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন এই গুনী অভিনেত্রী। সমসাময়িক দিতি, অঞ্জু ঘোষ, অরুনা বিশ্বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন চম্পা। সিনিয়র শাবানা, ববিতা, রোজিনার সাথেও কাজ করেছেন অনেক সিনেমায়৷ পরবর্তীতে নব্বই দশকে শাবনাজ, মৌসুমী, শাবনূরদের সময়েও কাজ করেছেন চুটিয়ে।

অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে পাঁঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। পদ্মা নদীর মাঝি, অন্য জীবন, উত্তরের ক্ষেপ, শাস্তি, চন্দ্রগ্রহণ এই সিনেমাগুলোর জন্য রাস্ট্রীয় ভাবে পুরস্কৃত হন তিনি। এছাড়া পেয়েছেন বাচসাস পুরস্কার। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আন্তর্জাতিক ‘তাসখন্দ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ থেকে পুরস্কৃত হয়েছিলেন তিনি।

তার সময়ের অনেকেই যখন কাজ থেকে দূরে আছেন সেখানে তিনি এখনো ভিন্নধর্মী গল্পের সিনেমায় ব্যতিক্রমী চরিত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত ‘বিশ্বসুন্দরী’ সিনেমায় তার অভিনয় ব্যাপক প্রশংসা পাচ্ছে সকলের। সামনে মুক্তি পাবে অমিতাভ রেজা পরিচালিত ‘রিকশাগার্ল’, এম রাহিম পরিচালিত ‘শান’, রাশিদ পলাশ পরিচালিত ‘পদ্মাপুরাণ’ এর মতো আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত সিনেমায় দেখা মিলবে তার।

এখন কাজ করেন খুব বেছে বেছে। তবে যে কাজটাই করেন সেটাতে নিজের পুরোটা নিয়েই হাজির হন ঢাকাই চলচ্চিত্রের টাইমলেস বিউটি খ্যাত এই গুনী অভিনেত্রী। শ্যুটিং বা অন্য কাজ না থাকলে নিজ বাসায় নিজের কাছের মানুষদের নিয়েই অবসর সময় কাটান তিনি।

তবে যমজ দুই নাতি আরজান-আরিশকে নিয়ে তার সময় বেশ সুন্দর কাটে বলে জানিয়েছেন একটি সাক্ষাৎকারে। বাংলা চলচ্চিত্রের এই খ্যাতনামা অভিনেত্রীকে আমাদের গল্পকার বা পরিচালকেরা সামনের দিনগুলোতে সুন্দর সুন্দর কনটেন্ট নিয়ে নির্মিত সিনেমায় আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং বৈচিত্র‍্যময় চরিত্রে উপস্থাপন করবেন সেটাই কাম্য।

Ad