তিনি আমাদের ‘তিশা’

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : নতুন কুঁড়ির মঞ্চ থেকে সিনেমার আলো ঝলমলে রঙিন জগৎ এককথায় পুরো যাত্রা পথটা খুব সহজ কিছু ছিল না। তার উপর ছিলো না অভিনয়ের কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, তিনি মঞ্চে অভিনয় করেননি কখনও। কিন্ত স্রষ্টা তাকে প্রতিভার ভাণ্ডার দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন, সেই প্রতিভাটাকে পরিশ্রমের কষ্টিপাথরে ঘষে ঘষে সাফল্যের হীরকখণ্ডে রূপান্তরিত করেছেন তিনি।

তিনি এই মুহূর্তে বাংলা নাটকের জগতে অবিসংবাদিতভাবে সেরা জনপ্রিয় অভিনেত্রী। চলচ্চিত্র মাধ্যমেও তিনি তার দক্ষতা এবং ডেডিকেশন দিয়ে নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন এক অন্য উচ্চতায়। তিনি আমাদের সবার প্রিয় তিশা। পুরো নাম নুসরাত ইমরোজ তিশা। আজ আমাদের দেশের এই গুণী এবং দক্ষ অভিনেত্রীর জন্মদিন।জন্মদিনে তাকে নিয়ে এই বিশেষ ফিচার।

১৯৯৫ সালে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান পাওয়া তিশার মিডিয়া জগতে পদার্পণ টেলিভিশনের মাধ্যমেই। শিশুশিল্পী হিসেবে মূলত গান করতেন। ১৯৯৭ সালে অনন্ত হীরার ‘সাতপৌড়ে কাব্য’ নামে একটি নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে শখের বশে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনয় জগতে পদার্পণ করেন। জনপ্রিয় ব্র‍্যান্ড কোকাকোলার বিজ্ঞাপন দিয়ে তিশার মায়াকাড়া চেহারাটা চিনে নিয়েছিলেন এদেশের টেলিভিশন দর্শকেরা।

এককথায় বলা যায় তখন থেকেই জনপ্রিয় তারকা হিসেবে এগিয়ে যাবার শুরু। অরণ্য আনোয়ারের ‘নূরুল হুদা একদা ভালোবেসেছিল’ নাটকটা দিয়ে সত্যিকার অর্থে অভিনেত্রী হিসেবে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করেন তিনি। তারপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার।

ক্যারম, ৬৯, ৪২০, গ্র্যাজুয়েট, মুকিম ব্রাদার্স, ইট কাঠের খাঁচা, কফি হাউজ, মনফড়িঙের গল্প, আরমান ভাই, উন মানুষ, তবুও বসন্ত, অ্যাংরি বার্ড, ভালোবাসি তাই ভালোবেসে যাই, বুকের ভেতর পাথর থাকা ভালো, কবিতার মতো গল্প, আয়েশা, কলি২.০, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আমি তৃনা ও ম্যাজিক, মুখ ও মুখোশের গল্প, হাফ হানিমুন সহ অসংখ্য জনপ্রিয় এবং দর্শকনন্দিত নাটকে অভিনয় করে নিজেকে এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে প্রমাণ করেছেন।

নাটকের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনেও তিনি সফল। দেশের অন্যতম সেরা একজন মডেল হিসেবেও নিজেকে প্রমান করেছেন তিনি। প্রথমেই কোকাকোলার বিজ্ঞাপন দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। তারপর একে একে সিটিসেল, কেয়া বিউটি সোপ, মেরিল বিউটি সোপ সহ বেশকটি বিজ্ঞাপনে কাজ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন তিশা।

ছোট পর্দা ছাড়িয়ে তিশা তার অভিনয়ের দ্যুতি ছড়িয়েছেন বড় পর্দায়। থার্ড পারসন সিংগুলার নাম্বার, টেলিভিশন, অস্তিত্ব, রানা পাগলা, ডুব, হালদা বা হালের ‘ফাগুন হাওয়ায়’, ‘মায়াবতী’ ‘হলুদবনি’ বা ‘ইতি তোমারই ঢাকা’ তিশা অভিনীত প্রতিটি সিনেমাই নান্দনিক এবং আলোচিত সিনেমা হিসেবে জয় করেছে দেশ বিদেশের নানা স্বীকৃতি এবং জনপ্রিয়তা।

সামনে আসছে ঢাকা-২০৪০, শনিবার বিকেল, বোবা রহস্য, রক্তজবা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক সহ আরো কিছু সিনেমা। ‘বঙ্গবন্ধু’ সিনেমায় শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করছেন তিশা। শ্যাম বেনেগালের পরিচালনায় বর্তমানে এই সিনেমার শ্যুটিং এর জন্য মুম্বাইয়ে রয়েছেন তিনি। কাজ করছেন আরেকটি বায়োপিকে। অবিভক্ত ভারতবর্ষের সংগ্রামী এবং সাহসী নারী নেত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার জীবন কাহিনী নিয়ে নির্মিতব্য অনুদানের সিনেমা ‘প্রীতিলতা’ তেও।

এছাড়া হালের বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কিছু ওয়েব সিরিজেও তিনি কাজ করছেন। বেশ কিছু বিগ বাজেটের প্রজেক্টে তাকে দেখা যাবে খুব শিগগিরই। করোনা পরিস্থিতিতে নতুন নাটকে তেমনভাবে কাজ না করলেও গ্রামীনফোনের একটি গেমশো উপস্থাপনায় দেখা মিলেছে তার। এছাড়াও প্রথমবারের মতো প্রযোজক হিসেবে তিশা আসছেন ‘নো ল্যান্ডস ম্যান’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। এই সিনেমায়র মধ্য দিয়ে বলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী বাংলাদেশের সিনেমায় অভিষেক ঘটাতে যাচ্ছেন।

তিশার অভিনয় প্রতিভা নিয়ে আসলে নতুন করে লেখার বা জানানোর কিছু নাই। যেকোন চরিত্রে যে কোনো লুকে তিশা তার দক্ষতা এবং সহজাত অভিনয় প্রতিভা দিয়ে জীবন্ত করে তুলে ধরার ক্ষমতা রাখেন। বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকজন অভিনেত্রীর মধ্যে তাই তার নাম থাকবে লিস্টের উপরের দিকে।

গ্রামের সাধারণ মেয়ে, মধ্যবিত্ত হাউজওয়াইফ, হারিয়ে যাওয়া স্বামীকে খুঁজতে থাকা এক অসহায় নারী, মানসিক ভাবে অসুস্থ এক মেয়ে, পতিতা, সিংগেল কর্মজীবি আধুনিক নারী, ডাকাত দলের সদস্য, উচ্চবিত্ত ঘরের আদরের কন্যা সহ এমন কোন চরিত্র নাই যা তিশা তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে ফুটিয়ে তোলেননি। জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরী, ইরেশ যাকের, তাহসান, আফরান নিশো, থেকে শুরু করে হালের সিয়াম, তৌসিফ, জোভান দের সাথেও চুটিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।

অনেকেই জানেন না যে, তিশা এঞ্জেল ফোর নামের একটি ব্যান্ড দলও গঠন করেছিলেন। যদিও পরবর্তীতে অভিনয় ব্যস্ততার কারণে সেটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তবে গানের প্রতি আলাদা একটা টান সব সময়েই কাজ করে তার। ব্যক্তিগত জীবনে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন দেশের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সারয়ার ফারুকী কে।

মিডিয়াতে যেখানে তারকাদের নানা স্ক্যান্ডাল এবং বিচ্ছেদের খবর কয়দিন পর পরই সমালোচনার ঝড় তোলে সেখানে তিশা-ফারুকী জুটি নিজেদের সংসার এবং কাজ দুটোই ব্যালেন্স রেখে সমান তালে করে যাচ্ছেন। ভালোবাসার অন্যতম সেরা জুটি হিসেবে মিডিয়াতে তাদের আলাদা একটা স্থান আছে।

অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে জনপ্রিয় মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার জিতেছেন রেকর্ড সংখ্যক ১৪ বার। এছাড়া ‘অস্তিত্ব’ সিনেমার জন্য প্রথমবার দেশের সবচেয়ে বড় সম্মান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৬ তে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন তিশা। ২০১৮ সালে ‘হালদা’ সিনেমার জন্য দ্বিতীয়বারের মতো জয় করে নিয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। নিজের মেধা, সততা, এবং অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিশা নিজেকে নিয়ে যাবে সফলতার আরো উচু স্থানে এবং সামনের দিনগুলোতে তার অসাধারণ অভিনয় প্রতিভা আমাদের এভাবেই মুগ্ধ করে যাবে তিশার জন্মদিনে এই কামনা রইলো।

Ad