জন্মদিনে অপি করিম

আফজালুর ফেরদৌস বলেন : বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে অল্প কাজ করেই যেকয়জন অভিনেত্রী নিজেদের মেধা, দক্ষতা আর সহজাত প্রতিভা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন জনপ্রিয়তার শীর্ষে তাদের মধ্যে উজ্জ্বল একটি নাম অপি করিম। পুরো নাম সৈয়দা তুহিন আরা অপি করিম।

মডেল, নৃত্যশিল্পী, উপস্থাপিকা, শিক্ষিকা, সেট ডিজাইনার এবং অভিনেত্রী সংস্কৃতির প্রায় সবগুলো শাখায় নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি সাবলীলভাবে। এই গুনী এবং জনপ্রিয় অভিনেত্রীর জন্মদিন উপলক্ষে আজকের বিশেষ ফিচার।

অপি করিম সর্বপ্রথম শিশু শিল্পী হিসেবে বিটিভির বহুল আলোচিত এবং জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘সকাল সন্ধ্যায়’ অভিনয় করেন। এই ধারাবাহিকে তার চরিত্রের নাম ছিল পারুল। এরপর অনেকদিন গ্যাপ দিয়ে সেই সময়কার জনপ্রিয় ম্যাগাজিন ‘আনন্দধারা’র প্রচ্ছদে মডেল হিসেবে নতুন করে মিডিয়াতে পদার্পন।

এবং এই আনন্দধারা ম্যাগাজিনের মাধ্যমেই ১৯৯৯ সালে অপি করিম মিস ফটোজেনিক পুরস্কার জয় করেন। পরবর্তীতে এই মেয়েটির মাঝেই বাংলাদেশের মানুষ দেখা পায় একজন মিস্টি হাসি আর অপূর্ব মায়াভরা চেহারার একজন অভিনেত্রীর।

সেই ১৯৯৯ সালেই ‘তেপান্তরের রুপকথা’ টেলিফিল্মের মাধ্যমে অভিনেত্রী হিসেবে যাত্রা শুরুর অপির। তবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘৫১বর্তী’ ধারাবাহিক দিয়ে নিজেকে জনপ্রিয়তার শিখরে নিয়ে যান অপি। অনেক জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ভীড়ে এই নাটকের মাধ্যমে একমাত্র অপিকেই দর্শক এখনো আলাদা একটা ভালোলাগার জায়গায় অধিষ্ঠিত করে রেখেছে।

তারপর একে একে আচল, দয়িতা, শুকনো ফুল, বৃষ্টির পরে, আলো আমার আলো, ছায়াযোগ, নুসরাত সংগে একটি গল্প, চড়ুইভাতি, তাহারা, পুরাঘটিত বর্তমান, বালক বালিকা, এই শহর মাধবীলতার না, হাউজফুল বা সাম্প্রতিক নীল গ্রহ, মিস শিউলি, ভিক্টিম সহ অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। সব প্রজন্মের দর্শকদের কাছ থেকেই পেয়েছেন ভালোবাসা এবং প্রশংসা।

ফেরদৌসী মজুমদার, সুবর্না মুস্তফা, শমী কায়সার, বিপাশা হায়াতের পরে অপিই একমাত্র অভিনেত্রী ছিলেন যাকে নিয়ে নির্মাতারা রিস্ক নিতেন এবং যেকোন চরিত্রে তার সাবলীলভাবে উতরে যাবার গুন তাকে কিংবদন্তী অভিনেত্রীদের তালিকায় অধিষ্ঠিত করেছিলো। টেলিভিশনে বর্নিল ক্যারিয়ারে স্বীকৃতি হিসেবে দুই বার দর্শকজরিপে এবং দুইবার সমালোচক জরিপে মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার জয় করেন তিনি।

অভিনয় পারদর্শীতার পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার নৃত্য পারদর্শীতাও অবাক করেছে তার ভক্তদের। ছোটবেলা থেকেই নাচ শিখতেন অপি। শাস্ত্রীয় নাচের তালিম নিয়েছেন তিনি দীর্ঘদিন। তার নাচ মুগ্ধ করে যায় দর্শককে। তাই অভিনয়ে ব্যস্ত হবার পরেও নিজের ভালোলাগার জায়গাটা ছেড়ে দেননি। বিশেষ দিনের নানা নৃত্য-আয়োজনে তার মনমাতানো উপস্থিতি আলাদা একটা মাত্রা যোগ করে আসছে বরাবরই।

সফলতার সাথে উপস্থাপনা করেছেন ‘আমার আমি’ ও অপি’স গ্লোয়িং চেয়ারের মত দুটি জনপ্রিয় সেলিব্রেটি শো। মঞ্চ নাটকেও কাজ করেছেন ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী চরিত্রে অভিনয় করে মঞ্চে সাড়া ফেলেন অপি।

পরবর্তী সময়ে নাগরিকের প্রযোজনায় ‘অপেক্ষমাণ’, নাম গোত্রহীন ‘মান্টোর মেয়েরা’ নাটকে অভিনয় করে নাটক পাড়ায় ছুঁয়েছেন দর্শকের হৃদয়। এই অভিনেত্রী এখন দেশের অন্যতম নাট্য সংগঠন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে নিয়মিত যুক্ত আছেন মঞ্চ নাটকে।‘ডিয়ার লায়ার’র মাধ্যমে প্রথমবার অন্য কোনো দলে অভিনয় করছেন তিনি।

টেলিভিশনের পরে চলচ্চিত্র মাধ্যমেও নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন অপি করিম। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ব্যাচেলার’ সিনেমায় সেই সময় হুমায়ুন ফরিদী, শাবনূর, ফেরদৌস, আহমেদ রুবেলের মতো জাদরেল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মাঝেও নিজের আলো ছড়িয়েছেন তিনি।

স্বীকৃতি হিসেবে প্র্থম সিনেমায় অভিনয় করেই জয় করে নেন বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। তবে পরবর্তীতে আর কোন সিনেমায় অভিনয় করেননি তিনি। তবে প্রায় চৌদ্দ বছর বিরতি দিয়ে তিনি ফিরছেন ‘মায়ার জঞ্জাল’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিষাক্ত প্রেম’ ও ‘সুবালা’ ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত এ সিনেমার নাম ‘ডেব্রি অব ডিজায়ার’।

এর বাংলা নাম রাখা হয়েছে ‘মায়ার জঞ্জাল’। যৌথভাবে পরিচালনা করছেন বাংলাদেশের জসীম আহমেদ ও কলকাতার জনপ্রিয় নির্মাতা ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী। এরই মধ্যে কলকাতায় সিনেমার শুটিং করেছেন অপি।

এ সিনেমায় অপি করিমকে কলকাতার একটি মেয়ের চরিত্রে দেখা যাবে, যার নাম সোমা। যেখানে উঠে আসবে, বেকার স্বামী ও একমাত্র সন্তান নিয়ে সোমার সংসার। সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে চাকরি করে সোমা। এক মধ্যবিত্ত গৃহিনীর চরিত্রে রুপালি পর্দায় আবারো চমকে দিবেন একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে।

গায়িকা হিসেবেও নিজের প্রতিভার প্রমান দিয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে সাগর জাহান রচিত ঈদের নাটক এ শহর মাধবীলতার না এর জন্য কণ্ঠ দেন। ‘ধুলোপড়া সময়’ শিরোনামের এই গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন মুন্তাসির তুষার। কিছুদিন আগেই আয়নাবাজি-খ্যাত নির্মাতা অমিতাভ রেজার প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘ঢাকা মেট্টো’তে অভিনয় করেছেন তিনি।

যেটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হইচই আললিমিটেডে প্রচার হয়েছে। এই ওয়েব সিরিজে অপি করিমের অনবদ্য অভিনয় আবারো দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে। অভিনেত্রী হিসেবে তিনি যে এখনো আমাদের দিতে পারেন অনেক কিছু তার প্রমান দিয়ে যাচ্ছেন তার অল্প কিন্তু মানসম্মত কাজগুলো।

টেলিভিশনে প্রচুর ব্যস্ত সময় কাটালেও বুয়েটের ছাত্রী হিসেবেও মেধা তালিকায় নিজের নাম উজ্জ্বল করেছিলেন অপি। বরাবরই ভালো ছাত্রী হিসেবে সুনাম ছিলো তার। জাপান থেকে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে ক্যারিয়ার হিসেবে স্থাপত্যবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। এবং অভিনয় কমিয়ে দিয়ে একটা সময় মনোনিবেশ করেন শিক্ষকতা পেশায়।

মাঝে বেশ কিছুদিন মিডিয়া থেকে দুরে থাকলেই তার জনপ্রিয়তা বা ক্রেজ কমেনি বিন্দুমাত্র। এখনো ভক্তদের কাছে অপি করিম মানেই অন্যকিছু এই বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছেন তিনি। তার হাসি, ব্যক্তিত্ব, দক্ষ অভিনয় এবং চরিত্রের সাথে মিশে যাবার সহজাত প্রতিভা তাকে ভক্তদের অন্তরে চিরস্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে।

ব্যক্তিজীবনে মাঝে কিছু ছন্দপতন ঘটলেও নির্মাতা এনামুল করিম নির্ঝরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার এবং ক্যারিয়ার সামলাচ্ছেন দক্ষ হাতে। গত ডিসেম্বরে কন্যা সন্তান এসেছে এই দম্পতির সংসারে। ব্যক্তিজীবনে এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছেন এই নন্দিত অভিনেত্রী। এখন বিশেষ দিনে হাতে গোনা নাটকে অভিনয় করলেও তার কাজ প্রশংসিত হয় সবার কাছেই।

অনেক কাজের ভীড়েও বছর শেষে আলোচিত অভিনেত্রীর তালিকার তার নাম জায়গা করে নেয় অনায়াসেই। নিজের বহুমুখী প্রতিভা আর সুন্দর হাসি নিয়ে তিনি আমাদের জন্য উপহার দিবেন আরো অনেক অনেক সুন্দর আর ভিন্নধর্মী কাজ এমনটাই কামনা। ১৯৭৯ সালের আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করা এই গুনী অভিনেত্রীর জন্য রইলো জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং শুভ কামনা।

Ad