নায়করাজ রাজ্জাককে হারানোর ৪ বছর!
আফজালুর ফেরদৌস রুমন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে অনেক স্টার, সুপারস্টার, মেগাস্টার নায়কের আসা যাওয়া ছিলো, আগে সংখ্যাটা অনেক হলেও এখন হাতে গোনা দুই একজনই আছে, হয়তো ভবিষ্যতে সংখ্যাটা বাড়বে। তবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে নায়ক রাজ একজনই তিনি রাজ রাজ্জাক।
ষাটের দশক থেকে নায়ক হিসেবে ঢালিউডে যে জয়যাত্রা তিনি শুরু করেছিলেন তা বজায় ছিলো টানা তিন দশক। শূন্য দশকে বয়স এবং সময়ের বিবেচনায় চরিত্রঅভিনেতা, পরিচালক হিসেবেও নিজেকে সফল হিসেবে তুলে ধরেছেন রাজ্জাক। আজকে চলচ্চিত্রের এই মহীরুহ রাজ রাজ্জাকের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে নিয়েই এই বিশেষ ফিচার।
১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি রাজ্জাক জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার টালিগঞ্জে। তার প্রকৃত নাম আব্দুর রাজ্জাক। টালিগঞ্জের মোল্লা বাড়ির আকবর হোসেন ও মিনারুন্নেসার ছোট ছেলে তিনি। জন্মের পর কলকাতায় বেড়ে ওঠা রাজ্জাকের। কখনই অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ ছিলো না তার বরং তার ইচ্ছে ছিলো খেলোয়াড় হওয়ার।
কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় মঞ্চ নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য তার স্পোর্টস শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাকে মূল চরিত্রের জন্য বাছাই করেন। অনেকটা অনিচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষকের কথায় তিনি ওই নাটকে অভিনয় করেন। কিন্তু আশ্চর্য্জনকভাবে সেদিন তার অভিনয় দেখে সবাই মুগ্ধ হন। এরপর থেকেই তিনি অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন।
এভাবেই আস্তে আস্তে অভিনয়ের প্রতি আসক্তি এবং ভালোবাসায় জড়িয়ে যান তিনি। সেসময় কলকাতায় অভিনয় করতে গিয়ে তিনি খ্যাতিমান অভিনেতা উত্তম কুমার, পরিচালক তপন সিনহা এবং পরিচালক পীযূষ সাহার সান্নিধ্যে আসেন। এর মাঝে ১৯৬২ সালে খায়রুন নেসার (লক্ষ্মী) সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে কলকাতায় দাঙ্গার পর ১৯৬৪ সালে শরণার্থী হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান তিনি।
সেই সময় স্ত্রী এবং ছয় মাসের পুত্র বাপ্পারাজকে নিয়ে নতুন দেশ এবং নতুন শহরে নতুন করে জীবন শুরু করেন তিনি। রাজ্জাকের চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। অভিনয় দিয়ে নিজের দক্ষতা প্রমান করে জনপ্রিয়তা লাভ করা ছিলো তার লক্ষ্য। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে তিনি থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। থিয়েটারে কাজ করতে করতে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন।
এরপর দু’বছর টেলিভিশন অভিনেতা হিসেবে কাজ করেন। ছোট পর্দায় ‘ঘরোয়া’ নামের ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের নজরে চলে আসেন রাজ্জাক। সালাউদ্দিন প্রোডাকশন্সের ‘তেরো নাম্বার ফেকু ওস্তাগড় লেন’ সিনেমায় ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরী স্টেশন-সহ আরও বেশ কয়েকটি সিনেমাতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করে ফেলেন।
অবশেষে রাজ্জাকের স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৬৮ সালে। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ সিনেমায় লক্ষিন্দরের চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে নায়ক হিসেবে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু হয় তার। এই সিনেমার ব্যাপক সাফল্যের পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকে হয়নি। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘আনোয়ারা’ আর তৃতীয় সিনেমা ‘আগুন নিয়ে খেলা’ সুপারহিট ব্যবসা করে। তৃতীয় সিনেমা রিলিজের পরেই তিনি তৎকালীন সময়ে পাকিস্তানের সুপারস্টার নায়ক খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
এর পরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার। ‘এতটুকু আশা’, ‘নাচের পুতুল’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘দর্পচূর্ন’, ‘পিচঢালা পথ’, ‘ময়নামতি’, ‘আবির্ভাব’, ‘দ্বীপ নেভে নাই’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘অবুঝ মন’, ‘রংবাজ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘কি যে করি’, ‘লাইলী-মজনু’, ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘বদনাম’, ‘ওরা এগারোজন’, ‘ক খ গ ঘ ঙ’, ‘বাবা কেন চাকর’ ‘সন্তান যখন শত্রু’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’ একের পর এক ব্যবসাসফল এবং নান্দনিক সিনেমা উপহার দিয়ে গেছেন তিনি।
‘নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা চলেছি একা’, ‘তুমি যে আমার কবিতা’, ‘আয়নাতে ওই মুখ’, ‘সে যে কেনো এলোনা’, ‘কাছে এসো যদি বলো’, ‘‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘হায়রে মানুষ রঙীন ফানুষ’, ‘হৈ হৈ রঙীলা রঙীলা রে’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি’, ‘প্রেমের নাম বেদনা’, ‘ও মাষ্টার সাব’, ‘আমার এ গান তুমি শুনবেই’, ‘আমার মতো এতো সুখী’ ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘‘দুঃখ কোরোনা বন্ধু তোমরা’ ‘বাবারে বাবা কই করলাম বিয়া’, ‘লাইলি তোমার এসেছে ফিরিয়া’ সহ অসম্ভব জনপ্রিয় গানগুলি শোনেননি এমন মানুষ বোধহয় এইদেশে পাওয়া যাবে না।
নায়ক রাজ রাজ্জাক সিনেমায় প্রথম জুটি বেধে কাজ করেছেন সেই সময়ের জনপ্রিয় নায়িকা সুচন্দার সঙ্গে। এরপর একে একে কবরী, শাবানা, সূজাতা, ববিতার সঙ্গে জুটি বেধে কাজ করেন তিনি। তবে রাজ্জাক-কবরী জুটি এক অনবদ্য সৃষ্টি। যুগের পর যুগ ধরে এই জুটির খ্যাতি শীর্ষে এখনো।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এই জুটির আবেদন এখনো অফুরন্ত। মাঝে দুজনের মধ্য অভিমানের কারনে দুরত্ব আসলেও একটা সময় সেটা ভুলে আবারো জুটি বেধে অভিনয় করেছিলেন তারা। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে ঢাকাই সিনেমার এই অভিভাবক আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
রাজ্জাক প্রায় ৩০০টি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নব্বই দশকের একটা সময় কলকাতার অনেক সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন তিনি। সেখানেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন রাজ্জাক। তবে শুধু অভিনয় নয়, নায়ক রাজ্জাক পরিচালক হিসেবেও ছিলেন সমান সাবলীল এবং জনপ্রিয়। অভিনয়ের পাশাপাশি ১৬টির বেশী সিনেমার পরিচালনা করা নায়ক রাজ্জাকের রয়েছে নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘রাজলক্ষী প্রডাকশন’।
এই প্রোডাকশনের ব্যানারে অনেক নান্দনিক সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। তার সর্বপ্রথম প্রযোজিত সিনেমা ‘আকাঙ্খা’। রাজ্জাক পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘অনন্ত প্রেম’ এবং সর্বশেষ তিনি পরিচালনা করেন ‘আয়না কাহিনী’ (২০১৪)। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বেশ দাপটের সাথেই ঢালিউডে সেরা নায়ক হয়ে অভিনয় করেন রাজ্জাক।
অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে কিছুটা গ্যাপ দিয়ে নায়ক চরিত্রের খোলস ছেড়ে বয়সের সাথে মিল রেখে চরিত্রঅভিনেতা হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। এবং ক্যারিয়ারের এই সময়ে এসেও তিনি জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন।
বিশেষ করে ‘বাবা কেন চাকর’ সিনেমায় তার অভিনয় দক্ষতা ঢাকাই সিনেমায় সফলতার মাইলফলক স্পর্শ করেছিলো। রাজ্জাক অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হন তার ক্যারিয়ার জুড়েই। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের বিশেষ শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ‘কি যে করি’ সিনেমাতে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।
মোট ৫ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ২০০৯ সালে চ্যানেল আই চলচ্চিত্র মেলায় রাজ্জাকের পরিবারকে সম্মাননা দেয়া হয় চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য। জাতীয় চলচ্চিত্র আজীবন সম্মাননা পান ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালে পান মেরিল প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা।
চলচ্চিত্র অঙ্গনের একমাত্র তিনিই জীবদ্দশায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পান। ২০১৫ সালের ২৫শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে এই পুরস্কার গ্রহন করেন রাজ রাজ্জাক। ২০১৭ সালের ২১শে আগষ্ট চিরবিদায় নিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আমাদের নায়ক রাজ রাজ্জাক।
সব পুরস্কার বা সম্মাননা একপাশে রেখে তার সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে তার ভক্ত, শুভাকাঙ্খী এবং সমর্থকদের ভালবাসা। এই অনন্ত ভালবাসাই নীল আকাশের নীচে তাকে বাচিয়ে রাখবে আমাদের মাঝে। আমাদের দেশের রূপালী পর্দার রাজার এমন স্বর্নালী রাজত্ব বেঁচে থাকুক ভক্তের ভালোবাসায় অনন্তকাল এটাই কামনা।