আজ থেকে প্রেক্ষাগৃহে ‘চন্দ্রাবতী কথা’

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী। মধ্যযুগে রচিত ‘মনসামঙ্গল’-এর অন্যতম রচয়িতা দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা চন্দ্রাবতী। ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র ‘জয়-চন্দ্রাবতী’ উপাখ্যানে তিনি অমর হয়ে আছেন। ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’, ‘রামায়ণ গীতিকা’ এই নারীকবির লেখা।

কিশোরগঞ্জের পাঠবাড়ী বা পাতুয়ারিয়া ছিলো তাঁর নিবাস। তবে তাঁর সৃষ্ট কবিতা বা গীতিকার চেয়েও তার নিজের বাস্তব জীবন অনেক বেশি নাটকীয় ছিলো। ষোড়শ শতাব্দীর অসম্ভব প্রতিভাবান এই নারী কবিকে নিয়ে এন রাশেদ চৌধুরী নির্মান করেছেন ‘চন্দ্রাবতী কথা’। আজ ১৫ই অক্টোবর মুক্তি পেতে যাচ্ছে এই সিনেমাটি।

চন্দ্রাবতীর জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের বাস্তব লোকেশনেই সিনেমার শ্যুটিং করা হয়েছে। এছায়ারাও ময়মনসিংহ এবং নেত্রকোনায় বিভিন্ন ঋতুতে সিনেমার শ্যুটিং করা হয়েছে গল্পটি বাস্তব এবং বিশ্বাসযোগ্য ভাবে সেলুলয়েডে উপস্থাপনের জন্য। পরিচালক থেকে শুরু করে ইউনিটের প্রতিটা শিল্পী এবং কলাকুশলী নিজেদের সেরাটাই দিয়েছেন এই পিরিওডিক্যাল সিনেমাটি নান্দনিকভাবে উপস্থাপনের জন্য।

২০১৫ সালে সরকারি অনুদান পাওয়া সিনেমাটি মুক্তি পেতে এত সময় লাগার কারণ হিসেবে জানা যায়, বিভিন্ন ঋতুতে সিনেমার শ্যুটিং এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে৷ তারপর একটা সময় সিনেমাটির কাজ শেষ হলেও সেন্সর ছাড়পত্র পেতে প্রায় বছর খানেক লেগে যায়।

এরমাঝেই করোনা পরিস্থিতিতে মুক্তি পিছিয়ে যায় প্রায় বছর দেড়েক। অবশ্য এর মাঝেই দুই বছর আগে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়েছিলো সিনেমাটির। সবমিলিয়ে একটু দেরীতে হলেও এই বিশাল ক্যানভাসের সিনেমাটি মুক্তি পাচ্ছে এটাও কম আনন্দের নয়।

এই ভিন্নধর্মী এবং ব্যতিক্রমী গল্পের সিনেমার বিশেষ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে গত মঙ্গলবার। স্টার সিনেপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত এই প্রিমিয়ারে দেশের অনেক গুনীজনের দেখা মিলেছে। প্রদর্শনী শেষে সকলেই এই চ্যালেঞ্জিং কনটেন্টের বিশ্বাসযোগ্য উপস্থাপনের প্রশংসা করেছে।

কারন একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে ষোড়শ শতাব্দীর কাহিনী তুলে ধরাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখনকার সময়ে এসে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সেই প্রেক্ষাপট, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা বেশ ভাবেই তুলে ধরেছেন নির্মাতা এবং পুরো টিম। এজন্য ধন্যবাদ এবং করতালি তাদের প্রাপ্য।

আমাদের দেশে চলচ্চিত্রে ইতিহাস, সাহিত্য বা সংস্কৃতি নিয়ে কাজ হয় খুব কম। আর ‘চন্দ্রাবতী কথা’য় ষোড়শ শতাব্দীর জীবন যাপন, সামাজিক নিয়ম নীতি, ধর্ম, হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী পালাগা, পটশিল্প সবকিছু নিয়েই বোনা হয়েছে চিত্রনাট্য যা সেলুলয়েডে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন কম ঝক্কির ছিলোনা। এক্ষেত্রে ‘চন্দ্রাবতী কথা’ সফল হয়েছে তা বলা যায়।

মূল ভূমিকায় দিলরুবা দোয়েল মানিয়ে গেছেন। তার সহজ এবং সুন্দর অভিব্যক্তি সাথে কিশোরগঞ্জের ভাষায় ডায়লগ ডেলিভারি চন্দ্রাবতী হিসেবে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করেছে। জয়ানন্দ চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণ নিজের সেরাটাই দিয়েছেন। বিয়ের সময় পালিয়ে যাওয়া, অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করা, অতঃপর পাগল হয়ে আবারো চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসা এবং তার পরিনতি সব মিলিয়ে এই চরিত্রে বর্ষণ মনে দাগ কাটবে।

আবার সোনাই চরিত্রে নওশাবার উপস্থিতিও ছিলো সাবলীল। তার চোখ এবং এক্সপ্রেশন মুগ্ধ করবে। গাজী রাকায়েত, আরমান পারভেজ মুরাদ নিজ নিজ চরিত্রে জাস্টিফাই করেছেন। দ্বিজ বংশীদাসের চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমান করেছেন তিনি কতোটা শক্তিশালী অভিনেতা। আবার স্বল্প সময়ে চন্দ্রাবতীর মা হিসেবে মিতা চৌধুরীও নিজের দক্ষতার ছাপ রেখেছেন।

তবে বাড়তি পাওয়া অশোক চরিত্রে তনয় বিশ্বাস। এই তরুন তার সাবলীল অভিনয় দিয়ে নজর কেড়েছেন। এছাড়া সিনেমায় কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহের গ্রামের সাধারণ মানুষেরাও অভিনয় করেছেন বিশেষ করে পালাকার বা বয়াতি- এ রকম চরিত্রগুলোতে সেখানকার গ্রামের মানুষই অভিনয় করেছেন।

প্রিমিয়ার শেষে সিনেমাটি নিয়ে সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, ‘বাঙলার ঐতিহ্যবাহী পালাগাণের কাঠামো, গল্প কথনরীতি, নান্দনিক অভিলাষ চন্দ্ৰাবতী কথা সিনেমায় সুনিপুণ কুশলতায় এন. রাশেদ চৌধুরীর চলচ্চিত্র-দৃশ্যকাব্যে রূপান্তরিত। এই প্রথম হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী পালাগানের অনুপ্রেরণায় একটি নতুন আঙ্গিকের চলচ্চিত্র আমাদের চলচ্চিত্রের সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিলো।’

‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ খ্যাত নির্মাতা মাসুদ হাসান উজ্জ্বলতার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন- ‘চন্দ্রাবতী কথার প্রিমিয়ার শো দেখে আসলাম। বাংলাদেশে বসে পিরিয়ডিকাল সিনেমা বানানো খুবই কঠিন। সেই হিসেবে পরিচালক এবং পুরো টিমকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। অভিনয়শিল্পীরা সবাই পরিচিত, দক্ষ অভিনেতা। সকলেই তার সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করেছেন।

আমার জন্য বাড়তি ভালোলাগার কারণ, এই সিনেমার নায়ক ইমতিয়াজ বর্ষণ। ঊনপঞ্চাশ বাতাসের পর কোন বিরতি না দিয়ে ওর অভিনীত দ্বিতীয় সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। এটা খুবই আনন্দের। দোয়েল, নওশাবা, রাকায়েত ভাই, মুরাদ ভাই, তনয়, জয়ন্ত দা’সহ সকলেই ভালো অভিনয় করেছেন। অভিনন্দন পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরী এবং পুরো টিমকে।’

  • চলচ্চিত্রের মন্দা সময়ে যখন মৌলিক গল্পের সিনেমা নির্মান কমে এসেছে সেখানে আমাদের নিজের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি নিয়ে এতো বিশাল ক্যানভাসের বড় আয়োজনের সিনেমা অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও সম্পন্ন করে মুক্তি দেয়ার সাহসের জন্য নির্মাতার প্রতি রইলো অনেক অনেক শুভেচ্ছা।

এই সিনেমার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজেদের গৌরব এবং ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুর নান্দনিক উপয়াথাপন এই প্রজন্মের কাছে পৌছাবে বলেই ধারনা করি। শুভকামনা রইলো পুরো ‘চন্দ্রাবতী কথা’ টিমের জন্য।

Ad