আলোচনায় দীপান্বিতা মার্টিন

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে অভিনেত্রী হিসেবে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেই ছোট্ট মেয়েটা সেটা এক পর্যায়ে এসে মিশে যায় বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম মানে চলচ্চিত্রে। কাজ করেছেন হাতেগোনা অল্প কিছু সিনেমায়। তবে সেই অল্প কয়টা চলচ্চিত্রে অসাধারণ অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি জয় করে নিয়েছেন প্রশংসা এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

এখন সিনেমার পাশাপাশি বিনোদনের নতুন মাধ্যম মানে ওটিটিতেও কাজ করছেনে দেশের এই গুণী অভিনেত্রী। এই ঈদে তিনি হাজির হয়েছেন ওটিটিতে তার তৃতীয় ফিকশন ‘কাইজার’ নিয়ে। যার কথা লিখছি বা বলছি তিনি সবার প্রিয় এক শক্তিশালী অভিনেত্রী দীপান্বিতা মার্টিন।

রাজধানীতে এক জোড়া খুনের রহস্য উদঘাটনে গোয়েন্দা কাইজারের সাথে যোগ দেন অফিসার মুনিরা আহসান। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক নারী সদস্য হিসেবে সাধাসিধে সালোয়ার কামিজ পরিহিত একজন শক্ত মানসিকতা, স্পষ্টভাষী এবং কিছুটা রুক্ষমূর্তি নিয়েই দীপান্বিতা মার্টিন যেনো সেলুলয়েডে এসেই জানান দিলেন এই ওয়েব সিরিজে তিনি অভিনয় প্রতিভার চমৎকার নমুনা দেখাতে এসেছেন বেশ আটঘাট বেঁধেই।

মার্ডারমিস্ট্রি ঘরানার এই নয় এপিসোডের জমজমাট সিরিজে আফরান নিশো, ইমতিয়াজ বর্ষণ, মোস্তাফিজুর নূর ইমরান, সুমন আনোয়ার, রিকিতা নন্দিনী শিমু, নাজিবা বাশার, আইশা খান, সৌম্যজ্যোতির মতো একদিকে যেমন দক্ষ ও জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী অন্যদিকে নবীন কিন্তু সম্ভাবনাময় শিল্পীদের মাঝেও দীপান্বিতা মার্টিন মুনিরা আহসান হিসেবে এক চমৎকার টুইস্ট নিয়েই হাজির হয়েছেন। তার চরিত্রটি প্রথম থেকে একটা সমান্তরাল লাইন মেনে এগিয়ে গেলেও গল্প যতো সামনের দিকে এগোয় মুনিরা গল্পে ততোটাই শক্তিশালী এক গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়।

একেবারেই নন-গ্ল্যামারাস এক তরুনী অফিসার হিসেবে পর্দায় তার উপস্থিতি নজর কাড়ে সকলের। আর সিরিজের শেষের দিকে একেবারে ৩৬০° ডিগ্রি ঘুরে সেই শক্ত মানসিকতার মেয়ে মুনিরা যে এমন খেল দেখাবেন তা কেই বা ভেবেছিলো!! একভাবে ভাবতে গেলে পুরো সিরিজের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ এলিমেন্ট ছিলেন দীপান্বিতা মার্টিন তথা মুনিরা আহসান। ভালোলাগার ব্যাপার হলো এই সারপ্রাইজ এলিমেন্ট হিসেবে দীপান্বিতা হতাশ তো করেননি আমাদের বরং সেলুলয়েডে সেই দুইটি লেয়ারের সেই চ্যালেঞ্জিং চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্য ভাবেই উপস্থাপন করেছেন তিনি।

দীপান্বিতার অভিনয়ের শুরুটা বিটিভির নাটকে শিশুশিল্পী হিসেবে। মঞ্চে হাতেখড়ি যখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন সময়েই মঞ্চে হাত-খড়ি হয় দীপান্বিতার। শহীদুল আলম সাচ্চুর নির্দেশনায় থিয়েটার সেন্টারের একটি একক পরিবেশনায় প্রথম মঞ্চে ওঠেন দীপান্বিতা। এ ছাড়া নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘চাঁদবণিকের পালা’, দেশ নাটকের ‘নিত্যপুরাণ’, মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস অবলম্বনে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের গল্প নিয়ে ‘বিরসা কাব্য’ তার কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

গুণী অভিনেত্রী এরইমধ্যে প্রায় শতাধিক টেলিভিশন নাটকে কাজ করেছেন। তবে টেলিভিশনের গুণী নির্মাতা নুরুল আলম আতিকের হাত ধরে ছোট পর্দায় আসা তার। এরপরে বড় পর্দায় হাজির হয়েছেন দীপান্বিতা। প্রথম চলচ্চিত্র বেলাল আহমেদের ‘মাটির জাহাজ’। ২০০৭-০৮ সালে নির্মিত চলচ্চিত্রটিও মুক্তির আলো দেখেনি। বিদেশের মাটিতে প্রশংসিত হলেও দেশের পর্দার জন্য সেন্সর ছাড়পত্র পায়নি আসাদ জামানের ‘জলঘড়ি’।

তবে গাজী রাকায়েতের ‘গোর’ সিনেমায় তার অভিনয় শুধু প্রশংসাই যে কেড়েছে তা নয়, সাথে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর খেতাব এবং সম্মান ও এনে দিয়েছে৷ পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানাভাবে আলোচিত ও স্বীকৃত চলচ্চিত্র রুবাইয়াত হোসেনের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ যা বাংলাদেশে ‘শিমু’ নামে রিলিজ পায় সেই সিনেমাতেও আলো ছড়িয়েছেন তিনি।

ছোট পর্দা আর বড় পর্দার পাশাপাশি ওয়েবেও নিজের দক্ষতার প্রমান দিয়েছেন তিনি। ইতিমধ্যে অভিনয় করেছেন তানিম নূরের পরিচালনায় হইচই এর আরেক আলোচিত ওয়েব সিরিজ ‘একাত্তর’ এবং রিহান রহমানের পরিচালনায় চরকির ওয়েব সিরিজ ‘নিখোঁজ’ এ। দুটি সিরিজেই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে নিজের ছাপ রাখা দীপান্বিতা নিজের তৃতীয় সিরিজ ‘কাইজার’এ এতো গুণী অভিনেতা এবং অভিনেত্রীর মাঝে হারিয়ে যাননি। বরং সালোয়ার কামিজ এবং পায়ে কেডস পড়া এক নারী অফিসার হিসেবে আমাদের সামনে এক অসাধারণ সুন্দর অভিনয় দক্ষতা দিয়ে মুগ্ধতাই ছড়িয়েছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে একটি সাক্ষাৎকারে দীপান্বিতা বলেন- সত্যিকথা বলতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্তির পর নিজের দায়িত্ব বেড়ে যাবার সাথে সাথে এখন একটি ফিকশনে কাজের সময় কিছুটা নার্ভাসনেসও কাজ করে অনেক। এমনকি কাইজারের সেটে শ্যুটিংয়ের সময় তার ভেতর একদম প্রথম দিন ক্যামেরার সামনে দাড়ানোর মতো অনুভূতি হয়েছে বলেও জানিয়েছেন গুণী অভিনেত্রী দীপান্বিতা। ‘কাইজার’ সিরিজে শুধু তার নয় বরং প্রতিটা চরিত্রই দর্শকদের ভালোলাগার কৃতিত্ব পুরো টিমের বলেই মনে করেন তিনি।

দীপান্বিতা জানান, আসলে গল্পকার, ডিরেক্টর, মেকাপম্যান, ক্যামেরাম্যান, কস্টিউম ডিজাইনার, সহ-শিল্পী সহ ইউনিটের সবার সাহায্যেই একটা চরিত্র পর্দায় সফলভাবে উপস্থাপিত হয়। মুনিরা আহসান চরিত্রটির সফল উপস্থাপন তাই নিজের পরিশ্রমের পাশাপাশি পুরো টিমের সহযোগিতার ফসল।

সামনে মুক্তির প্রতীক্ষায় আছে নুরুল আলম আতিকের ‘মানুষের বাগান’, নূর ইমরান মিঠুর ‘পাতালঘর’, অমিত আশরাফের ‘কাঁঠাল’, ফজলে রাব্বির ‘পায়ের তলায় মাটি নাই’, সেঁজুতি সুবর্ণা টুশির ‘রিপলস’, সাইফুল ইসলাম মান্নুর ‘পায়ের ছাপ’। সব মিলিয়ে বলা যায় এই সময়ে ভিন্নধারার সিনেমাতে অপরিহার্য এক নাম হয়ে উঠেছেন দীপান্বিতা।

অভিনয় দক্ষতা, প্রতিটা চরিত্রেই নিজের সাবলীল উপস্থিতি দিয়ে তিনি জয় করছেন দর্শক সমালোচকদের হৃদয়। সামনের দিনেও তার এই স্রোতের বিপরীতে যেয়ে গল্প এবং চরিত্র নির্বাচন তাকে অভিনেত্রী হিসেবে নিয়ে যাবে অনেকটা দূর এটাই কামনা। শুভকামনা রইলো নান্দনিক অভিনেত্রী দীপান্বিতা মার্টিনের জন্য।

Ad