বানিজ্যিক এবং আর্ট দুই ধারাতেই এখনো অনবদ্য টাবু

আফজালুর ফেরদৌস রুমন 

কিছু কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী ভিন্ন ধারায় সফল হলেও তাদের বেশির ভাগই মূলধারায় ব্যর্থ হয়ে অফ-ট্র্যাকে পা রেখেছিলেন। মূলধারায় জনপ্রিয় হবার জন্য অনেক সময় শুধু ভালো অভিনয়টাই যথেষ্ট নয়, এর সাথে বাহ্যিক সৌন্দর্য কিংবা আরো কিছু বিষয় চলে আসে। অনেক সময় কোনো এক বিচিত্র কারণে বাহ্যিক সৌন্দর্যসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকেও বাণিজ্যিক ঘরানার সিনেমায় দর্শকরা গ্রহণ করেন না। তবে এই সমীকরণ বদলে দেয়া একটি নাম হচ্ছে টাবু। বলিউডের এই শক্তিশালী এবং দক্ষ অভিনেত্রী বানিজ্যিক এবং ভিন্নধারা দুটি মাধ্যমেই জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা পেয়েছেন। জন্মদিন উপলক্ষে তাকে নিয়ে আজ এই বিশেষ ফিচার।

তাবাচ্ছুম টাবু হাশমী নামে ১৯৮২ সালে বাজার নামক সিনেমায় একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এবং পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে চৌদ্দ বছর বয়সে ‘হাম নওজোয়ান’ নামক সিনেমায় দেব আনন্দের মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করে সবার নজরে আসেন। তবে অভিনেত্রী হিসেবে তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ভেঙ্কটেশের সঙ্গে তেলুগু ভাষায় ‘কুলি নাম্বার ওয়ান’। প্রধান নারী অভিনেত্রী হিসেবে টাবুর প্রথম হিন্দি চলচ্চিত্র ছিল ‘পেহলা পেহলা প্যায়ার’ যেটি ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। এটি বক্স অফিসে তেমন সাড়া পায়নি। একই বছর অজয় দেবঘনের বিপরীতে ‘বিজয়পথ’ সিনেমা তাকে নায়িকা হিসেবে জনপ্রিয়তা এবং খ্যাতির ঝলক দেখায়। এই সিনেমায় ‘রুক রুক রুক আরে বাবা রুখ’ বা ‘রাহো মে উনছে মুলাকাত’ গানগুলো এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়। এবং এই সিনেমায় অভিনয় করে ওই বছর সেরা নবাগতার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তারপরের গল্পটা শুধুই এগিয়ে যাবার।

 

বানিজ্যিক সিনেমার সফলতা তাকে আনন্দিত করতো, জনপ্রিয়তা, খ্যাতি এবং প্রশংসা পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে তৃপ্ত একজন শিল্পী হিসেবে অভিনয়ের ক্ষুধা তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। এবং উল্লেখ্য নব্বই দশকে নারী অভিনেত্রীদের নিয়ে তেমন কোন গল্প বা সিনেমা নির্মান করা হতোনা। তাই টাবু ঝুকেছিলেন ভিন্নধর্মী সিনেমার প্রতি। যেখানে নায়িকারা এসব সিনেমার দিকে মনোযোগ দেন চল্লিশ পার করার পর সেখানে টাবু ২৪/২৫ বছর বয়সেই পা রাখেন। এবং সাফল্যের দেখা পান। বলিউডে পরিবর্তন আসার পেছনে যে কয়জন বানিজ্যিক সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কন্ট্রিবিউশান আছে তাদের লিস্টে টাবুর নাম উপরের দিকেই থাকবে।

শিশু অভিনেত্রীর সময়কাল বাদ দিলে প্রায় ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে ‘মাচিস’, ‘কালাপানি’, ‘হু তু তু’ ‘ভিরাসাত’ ‘শিকারি’ ‘চাঁদনি বার’ ‘জিত’ ‘সাজন চলে শ্বশুরাল’ ‘চাচী ৪২০’ ‘মকবুল’ ‘হায়দার’ ‘দ্যা নেমসেক’ ‘চিনি কম’ ‘হেরাফেরি’ ‘আন্ধাধুন’ ‘দৃশ্যম’ ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ ‘গোলমাল এগেইন’, ‘দে দে পেয়ার দে’ বা ‘এ সুইটেবল বয়’ অথবা সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত ‘ভুল ভুলাইয়া ২’ এর মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। কলকাতায় আলোচিত এবং জনপ্রিয় সিনেমা ‘আবার অরন্যে’ সিনেমাতেও সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর বা আমাদের দেশের খ্যাতিমান অভিনেত্রী চম্পার মতো শক্তিশালী শিল্পীদের সাথে স্ক্রিন শেয়ার করেও সমুজ্জ্বল ছিলেন তিনি স্বমহিমায়। বানিজ্যিক এবং ভিন্নধারার সিনেমা টাবু প্রমান করেছেন দুটি ক্ষেত্রেই সফল হওয়া যায় যদি অভিনয় প্রতিভা এবং অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকে।

ইন্ডাস্ট্রিতে কারো সাথে কখনোই কোন ঝামেলায় জড়াননি টাবু। ব্যক্তিজীবনে চুপচাপ এবং বই পাগল এই অভিনেত্রী শুধু কাজকেই প্রাধান্য দিয়েছেন বরাবর। সবার সাথেই তার সম্পর্ক ভালো। বক্স অফিসেও সাফল্য পেয়েছেন পেয়েছেন কঠোর সমালোচকদের কাছ থেকেই প্রশংসা। দুইবার জিতে নিয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। চারবার জিতেছেন ফিল্মফেয়ার। বানিজ্যিক এবং বিকল্পধারা দুই কুল সমানভাবে ‘রক্ষা’ করে চলা টাবুর মতো কম অভিনেত্রীই আছেন বলিউডে।

ক্যারিয়ার যখন পড়তির দিকে তখন ‘হায়দায়’ দিয়ে চমকে দিয়েছিলেন। কার্যত এই সিনেমার পর থেকেই একেবারে বেছে বেছে অভিনয় করছেন। যে জন্য পরের পাঁচ বছরে করা আটটি সিনেমার পাঁচটিই আলোচিত এবং ব্যবসাসফল। এর মধ্যে আছে ‘দৃশ্যম’, ‘গোলমাল এগেইন’, ‘আন্ধাধুন’ ‘দে দে পেয়ার দে’ এবং ‘ভুল ভুলাইয়া ২’ এবনফ নেটফ্লিক্সের ‘এ সুইটেবল বয়’। তার সময়ে তার সাথে ক্যারিয়ার শুরু করা অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী যেখানে অন্তরালে চলে গেছেন সেখানে টাবু কাজ করছেন বিরতিহীনভাবে। একের পর এক ভিন্নধর্মী সিনেমা নিয়ে হাজির হচ্ছেন তিনি এই বয়সেও। তার সৌর্ন্দয্য এবং অসাধারন অভিনয় দক্ষতা যেন আরো পরিনত হচ্ছে দিন দিন।

পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে নানা ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন টাবু, সবগুলোতেই মানিয়ে গেছেন অসাধারন ভাবে। সারাবিশ্বে এখন বিনোদনের অন্যতম জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ওয়েব সিরিজ আলোচিত হচ্ছে। ভারতেও অনেকগুলো ওয়েব সিরিজ এরইমধ্যে আলোচিত এবং জনপ্রিয় হয়েছে। সামনের বড় পর্দার কাজগুলোর সঙ্গে ওয়েব নিয়েও খুব আশাবাদী টাবু। তাঁর মতে, এই ঘরানায় দারুণ দারুণ কাজের সুযোগ আছে। এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুব সহজেই কাজ নিয়ে সারাবিশ্বের দর্শকদের কাছে পৌছে যাওয়া যায়। জুনিয়র অভিনেতা ঈশান খাট্টারের সাথে তার অভিনয় দক্ষতা বয়সের ফারাক মুছে দিয়েছে অবলীলায়। সামনে বিশাল ভরদ্বাজের বহুল আলোচিত ‘খুফিয়া’ সিনেমাতেও দেখা মিলবে তার।

কিছুদিন আগে এক অনুষ্ঠানে এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিল- প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি বয়সে এসেও মেইনস্ট্রিম এবং আর্টফিল্ম দুটো মাধ্যমেই সমান তালে সাফল্য পেয়ে যাচ্ছেন? এর রহস্য কি??

কিছুক্ষন হেসে টাবু বলেছিলেন- ‘আমার ধৈর্য্য অনেক। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই মায়ের চরিত্র নাকি মেয়ের চরিত্র এসব নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনো, শুধু ভালো চরিত্র চেয়েছি। ছোট চরিত্র, বড় চরিত্র যখন যেখানে যেমন সুযোগ পেয়েছি করেছি। এটাই ক্যারিয়ারকে একটা স্থিতিশীল অবস্থা দিয়েছে,। আমি দেখতে গুরুগম্ভীর মনে হলেও আমি কিন্তু একেবারেই উল্টো। যেচে মানুষের সঙ্গে আলাপ করি। এ জন্য নানা পেশার নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় আছে। ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র করতে গিয়ে মানুষের সঙ্গে মেশার অভিজ্ঞতা আমাকে সাহায্য করেছে।

নিজ গুন, মেধা এবং সময়ের সাথে নিজেকে বদলে নেয়া টাবু আজ বলিউডের এক প্রশংসনীয় এবং জনপ্রিয় নাম। সৌন্দর্য্য, ব্যক্তিত্ব, অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিনি আরো অনেকদিন কাজ করে যাবেন ভক্ত এবং দর্শকদের জন্য এটাই কামনা। শুভকামনা রইলো এই দক্ষ এবং গুনী অভিনেত্রীর জন্য।

Ad