‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ আইকনিক রোমান্টিক সিনেমা মুক্তির ৩০ বছর পূর্তি
আফজালুর ফেরদৌস রুমন
নব্বই দশকের শুরুতে বাংলা চলচ্চিত্রে একঝাঁক তরুনের হাত ধরে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিলো। সেই সূচনালগ্নের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত সিনেমা ’কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। ১৯৯৩ সালের আজকের দিনে এই সিনেমাটি রিলিজ পাবার পরেই শুধুমাত্র বক্সঅফিস সাফল্য নয় বরং আমাদের ইন্ডাস্ট্রি পেয়েছিলো চলচ্চিত্র জগতের দুই মহাতারকাকেও। ক্যালেন্ডারের হিসেবে মুক্তির ৩০ বছর পূর্ণ করলো এই আইকনিক রোমান্টিক সিনেমাটি। মুক্তির এতো বছর পরে এই ২০২৩ সালে দাঁড়িয়েও ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার আবেদন এখনো একই রকম যা সত্যিই বিস্ময়কর।
দুই প্রভাবশালী পরিবারের দ্বন্দ্ব, দুই পরিবারের মাঝে পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা না জেনেই পরবর্তী জেনারেশনের দুই তরুন-তরুনীর অবুঝ ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, টানাপোড়েন, বাড়ি থেকে পালিয়ে সংসার বাধা এবং শেষে দুইজনের স্তব্ধ করে দেয়া বিয়োগাত্মক সমাপ্তি এই নিয়েই সোহানুর রহমানের সোহানের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। সিনেমার গল্প সেই সময়ে যেমন নতুনত্বের স্বাদ দিয়েছিলো তেমনি অসাধারণ শ্রুতিমধুর গানগুলি এখনো সমানভাবে জনপ্রিয়। সাথে শক্তিশালী সংলাপ, প্রতিটি অভিনয় শিল্পীর বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় এই রোমান্টিক গল্পের সিনেমাটিকে ক্লাট ক্ল্যাসিক সিনেমা হিসেবে জায়গা করে দিয়েছিলো। তবে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে দুই নবাগত সালমান এবং মৌসুমী। তাদের দুজনের পারসোনালিটি, ফ্যাশন সেন্স, অদ্ভুত সুন্দর কেমেস্ট্রি এবং প্রথম সিনেমাতেই শক্তিশালী অভিনয় প্রতিভা এই সিনেমাটিকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন স্বতন্ত্র অবস্থানে যা এতো বছর পেরিয়ে এসেও অটুট আছে।
বলিউডের অফিশিয়াল রিমেক হলেও আমাদের দেশের সমাজব্যবস্থা বা সংস্কৃতির সাথে মিল রেখে এই সিনেমাটি নির্মান করেছিলেন সোহানুর রহমান সোহান। আমির খান ও জুহি চাওলা অভিনীত হিন্দি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ চলচ্চিত্রের কাহিনি লিখেছিলেন নাসির হোসেন আর পরিচালনা করেছিলেন মনসুর খান। এদিকে বাংলাদেশে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন সোহানুর রহমান সোহান ও সংলাপ লিখেছেন আশীষ কুমার লোহ। উল্লেখ্য প্রযোজক সুকুমার রঞ্জন ঘোষের আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেডের ব্যানারে নির্মিত হয় ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’।
বিখ্যাত গায়িকা রুনা লায়লা এবং নবাগত গায়ক আগুনের গাওয়া ‘ও আমার বন্ধু গো’, ‘এখন তো সময় ভালোবাসার’, ‘একা আছি তো কি হয়েছে’, ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে’ এর মতো সুপার ডুপার হিট গানের কল্যানে মৌসুমী এবং সালমান শাহ দর্শকদের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছিলেন অল্প সময়েই। প্রথম সিনেমা দিয়েই এতোটা খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তা ঢাকাই চলচ্চিত্রে আর কোন তারকা পেয়েছিলেন কিনা তা জানা নেই। মাত্র চারটা সিনেমায় জুটি বেধে সালমান-মৌসুমী ঢাকাই সিনেমার অন্যতম সেরা জুটি হিসেবেও নাম লিখিয়ে নিয়েছিলেন। দুজনের জুটি স্ক্রিনে যতোটা প্রানবন্ত ছিলো তরুন-তরুনী তো বটেই কিশোর থেকে বয়স্ক সবার কাছেই পেয়েছিলো তুমুল গ্রহণযোগ্যতা। প্রথম সিনেমাতেই ‘চকোলেট বয়’ বা ‘লাভার বয়’ তকমা জুটে যায় সালমানের নামের আগে। অন্যদিকে ফটোসুন্দরী মৌসুমীর স্নিগ্ধ এবং লাবন্যময় চেহারা, মিস্টি হাসি আর ঘন-কালো চুলের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। ঢাকা, চট্রগ্রাম সহ দেশের অনেক জায়গার বিউটি পার্লারে মৌসুমী কাটের স্ট্যাইলে চুল কাটতে রীতিমতো ভিড় জমিয়েছিলেন সেই সময়ের তরুনীরা। যে স্টারডম এবং খ্যাতি মৌসুমী এবং সালমান পেয়েছিলেন এই ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার রাজ এবং রেশমীর বদৌলতে তা এককথায় অবিশ্বাস্য!!
আমার কাছে এই সিনেমার সবথেকে শক্তিশালী দিক নিঃসন্দেহে সিনেমার প্রধান চরিত্র ও পার্শ্বচরিত্রগুলির প্রশংসনীয় অভিনয় দক্ষতা। সালমান-মৌসুমী কতটা ভালো অভিনয় করেছেন সেটা এই সিনেমার জনপ্রিয়তাই বলে দিয়েছিলো। কিন্তু পার্শ্বচরিত্রের বাকি শিল্পীরা যেমন রাজিব, আবুল হায়াত, আহমেদ শরীফ, খালেদা আখতার কল্পনা, টেলি সামাদ, মিঠু, ডন, জাহানারা আহমেদ, অমল বোসও দ্যুতি ছড়িয়েছেন স্ক্রিনে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড হিন্দি ‘সানাম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’–এর কপিরাইট নিয়ে সোহানুর রহমান সোহানের কাছে আসে এর যেকোনো একটির রিমেক করার জন্য। উপযুক্ত নায়ক-নায়িকা খুঁজে না পেয়ে সম্পূর্ণ নতুন মুখ দিয়ে ছবি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। নায়িকা হিসেবে মৌসুমীকে নির্বাচন করেন। নায়ক হিসেবে প্রথমে তৌকীর আহমেদ ও পরে আদিল হোসেন নোবেলকে প্রস্তাব দিলে তাঁরা ফিরিয়ে দেন। তখন নায়ক আলমগীরের সাবেক স্ত্রী খোশনুর আলমগীর ‘ইমন’ নামের এক ছেলের সন্ধান দেন। প্রথম দেখাতেই তাঁকে পছন্দ করেন পরিচালক এবং ‘সনম বেওয়াফা’ রিমেকের জন্য প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইমন ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর জন্য পীড়াপীড়ি করেন। এ ছবি তিনি ২৬ বার দেখেছেন। শেষ পর্যন্ত পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন ও ইমনের নাম পরিবর্তন করে সালমান শাহ রাখা হয়।
প্রথম আলোর সুত্রমতে- ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ রিলিজের আগে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহ মালিকেরা বেশকিছু পোস্টার ছাপায় সিনেমার প্রমোশনের লক্ষ্যে। যেমন- ‘উপমহাদেশের সাড়া জাগানো প্রেমকাহিনির সিনেমা। আসিতেছে ঈদুল ফিতরের শ্রেষ্ঠ ছবি “কেয়ামত থেকে কেয়ামত”। যে ছবি দেখার জন্য এখন থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি পরিলক্ষিত হচ্ছে দর্শকদের মধ্যে। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ফটোসুন্দরী মৌসুমী ও লাভার বয় সালমান শাহ অভিনীত “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবি ঝড় তুলবেই।’ এসব কথা লেখা বিভিন্ন পোস্টার রিলিজের আগে ছাপা হলেও রিলিজের পর দেখা গেলো সবকিছুই মিলে গিয়েছিলো পুরোপুরি। পোস্টারের সেই কথাগুলো মিথ্যা হয়নি।
৩০ বছর পূর্ণ করা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমাটি আমাদের ঢাকাই সিনেমার একটি মাইলফলক। এর থেকে বেশি ব্যবসাসফল সিনেমা হাতেগোনা কয়েকটা আমরা আগে এবং পরে পেয়েছি এটা যেমন সত্য তেমনি এই সিনেমার মতো করে ইন্ডাস্ট্রির বাক বদল অন্য কোনো সিনেমা করতে পেরেছে বলেও মনে হয়না। যে ক্রেজ, ফ্যানিজম এবং ভালোবাসা এই সিনেমা অর্জন করেছিলো তা সোনালী অক্ষরে লেখা থাকবে চলচ্চিত্র ইতিহাসের পাতায়। সালমান-মৌসুমী জুটির নামও লেখা থাকবে এই সিনেমা দিয়েই যার আবেদন ৩০ কেনো ৩০০ তেও মলিন হবেনা….