সারোজ খান : একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : আবারো শোকের ছায়া বলিউডে। এবার চলে গেলেন বলিউডের প্রখ্যাত এবং কিংবদন্তি কোরিওগ্রাফার সারোজ খান। প্রায় চার দশক ধরে ২ হাজারের বেশি গানে কোরিওগ্রাফার হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। বলা হয়ে থাকে সারোজ খানের হাত ধরেই বলিউড কোরিওগ্রাফির সেক্টরে ভিন্ন একটা জায়গা করে নেয়।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন সারোজ খান। গত কয়েকদিন ধরেই মুম্বাইয়ের বান্দ্রার গুরু নানক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন সারোজ খান। শ্বাসকষ্টজনক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭১ বছর। তার মৃত্যুতে বলিউডে নেমে এসেছে শোকের ছায়া।

অনেক কালজয়ী গান সেলুলয়েডে নায়ক-নায়িকাদের পারফরম্যান্স দিয়ে আলাদা ভাবে একটি নিজস্ব জায়গা দখল করে নিয়েছিল সারোজ খান। সেই কোরিওগ্রাফার বা ড্যান্সগুরুদের কখনোই কোন পুরস্কার বা সম্মানে সম্মানিত করা হয়নি। কোন পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্যে দিয়ে প্রথমবার স্বীকৃতি মিলেছে ১৯৮৮ সালে ‘তেজাব’ সিনেমার ‘ এক দো তিন’ গানের মধ্য দিয়ে।

পর্দায় মোহনীয় মাধুরী দীক্ষিতের নাচ এবং এক্সপ্রেশনে পাগল হয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। বলা ওই এক গান দিয়েই রাতারাতি সুপারস্টার বনে যান মাধুরী। আর সেই গানের জনপ্রিয়তা এবং স্বতন্ত্রতার পুরস্কার হিসেবে প্রথমবার বলিউড ইতিহাসে কোন কোরিওগ্রাফারকে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রদান করা হয়।

বলিউডের গানে সবসময়ই পুরুষদেরকে ড্যান্স ডিরেক্টর বা কোরিওগ্রাফার হিসেবে দেখা গেছে। সেই সময় নিজের দক্ষতা এবং ভিন্নধর্মী স্টেপের মধ্য দিয়ে বলিউডে প্রথম সফল নারী কোরিওগ্রাফার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সারোজ খান। ‘এক দো তিন’ মাধুরীকে রাতারাতি সুপারস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, সাথে সাথে সারোজ খান পেয়ে যান পুরুষ নিয়ন্ত্রিত বলিউডে তার নিজস্ব আসন।

তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তারই দেখানো পথ ধরে পরবর্তীতে অনেক নারী এই পেশায় আসার স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন। আজ জনপ্রিয় এবং দক্ষ কোরিওগ্রাফার হিসেবে ফারাহ খান, বৈভবী মার্চেন্ট এর মতো নারী কোরিওগ্রাফার বলিউডে যে জায়গায় নিজেদের অধিষ্ঠিত করেছেন সেই শুরুটা হয়েছিলো সারাজ খানের হাত ধরেই। বলিউডে কোরিওগ্রাফার অনেক আছে তবে ‘মাষ্টারজী’ একজনই। তিনি সারোজ খান।

এক দো তিন, ধাক ধাক করনে লাগা, চান্নে কে ক্ষেত ম্যায়, মেরা পিয়া ঘার আয়া, ম্যায় তেরা নাগিন, কাটে নাহি কাটতে ইয়ে দিন ইয়ে রাত, কিসিকে হাত না আয়েগী ইয়ে লারকি, থাম্মা থাম্মা, চোলি কে পিছে ক্যায়া হ্যায়, হাওয়া হাওয়াই, মেরে হাতো ম্যায় ন ন চুরিয়া হ্যায় সহ আশির শেষদিকে নব্বই দশকের প্রথমার্ধে প্রায় সব জনপ্রিয় গানই কোরিওগ্রাফি করেছেন সারোজ খান। শ্রীদেবী এবং মাধুরী দীক্ষিত এর সাথে তার জুটি বলিউডে ভিন্ন এক মাত্রা লাভ করেছিলো।

পরবর্তীতে কারিশমা, জুহি, টাবু, কাজল, উর্মিলা, ঐশ্বরিয়া, রানি, প্রীতি, কারিনা, প্রিয়াঙ্কা থেকে এই প্রজন্মের আলিয়া, সোনাক্ষী সহ প্রায় সব বলিউডের অভিনেত্রীদের সাথে কাজ করেছেন সারোজ। পরবর্তীতে ‘নিম্বুরা নিম্বুরা’ ‘ইয়ে ইশক হায়ে’ ‘ডোলা রে ডোলা’ ‘তাল সে তাল মিলা’ ‘ছাম্মাক ছাল্লো ছাল ছাবিলা’ সহ আরো অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন সারোজ খান।

তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া সারোজ খান ফিল্মফেয়ারে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। তিনি ২০০৬ সালে ‘ইয়ু হোতা তো ক্যায়া হোতা’ সিনেমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ২০১৩ সালে ‘এবিসিডি’ সিনেমার একটি গানেও ক্যামিও করেছিলেন সারোজ খান। গত বছর হিন্দি সিনেমায় তার অসাধারন অবদানের জন্য তাকে লাইফ টাইম এচিভমেন্ট পুরস্কার দেয়া হয় আইফা’র তরফ থেকে।

পুরস্কারটি তাকে তুলে দেন তার সবচেয়ে প্রিয় ছাত্রী মাধুরী দীক্ষিত। বিভিন্ন ইন্টারভিউ তে সারোজ খান বরাবরই বলে এসেছেন এই ইন্ডাস্ট্রিতে মাধুরী দীক্ষিত তার সবচেয়ে প্রিয় স্টুডেন্ট। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে বলিউডে তার করা শেষ কোরিওগ্রাফি ও মাধুরীর সাথেই ‘কলঙ্ক’ সিনেমায় ‘তাবাহ হো গায়ে’ গানে।

তার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, মাধুরী, অক্ষয় কুমার, সুভাষ ঘাই, হৃতিক রোশান, কাজল, রিতেশ দেশমুখ, কারিশমা, ঐশ্বরিয়া, কারিনা থেকে আলিয়া, বরুন ধাওয়ান, সোনাক্ষী সহ প্রায় পুরো বলিউড সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোক জানিয়েছেন। তার চলে যাওয়াটা হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে একটি সোনালী অধ্যায়ের সমাপ্তি হলেও সারোজ খান তার রেখে যাওয়া কাজের মধ্য দিয়ে অমর হয়ে রইবেন হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে।

Ad