চয়নিকা দিদির চতুর্থ শতক ‘গল্প নয়’ এক অনবদ্য বয়ান

টিভিতে নাটক দেখিনা ছয়-সাত বছর হলো। দেখিনা, কারণ ভাল লাগে না। তাই দেখার প্রয়োজন পরেনা। এই অনীহার প্রথম কারণ বিজ্ঞাপণ বিরতি। দ্বিতীয় কারণ মানহীন গল্প। সেকারণেই অনেক ভাল গল্পের নাটক যে মিস করিনি সেটা নয়, কিন্তু গড় পড়তা খারাপ নাটকের আধিক্যের কারণেও এটা হয়েছে। আমার মতো অনেক মানুষই টেলিভিশন বিমুখ।

এর জন্য পরিচালকরা যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী কলিমুদ্দি সলিমুদ্দিরা, যারা টেলিভিশন লাইসেন্স পেয়ে গেছে অনায়েসে। ইদানিং স্বাস্থ্য বিভাগের পণ্ডিতদের দেখতেও বসি।
তবে আজ নাটক দেখবো বলে পাক্কা নিয়ত করেছি। এর একটা বিশেষ কারণও আছে। সেটা হলো নাট্য ও চলচ্চিত্র নির্মাতা চয়নিকা দিদি (চয়নিকা চৌধুরী) ব্রায়ান লারার মতো একটা মস্ত রেকর্ড করে বসেছেন।

একজন পরিচালক যিনি কিনা ৪০০তম টেলিভিশন নাটক নির্মান করে ফেলেছেন! তাও একজন নারী হয়ে এই কীর্তি গড়লেন দিদি। ‘এনটিভির ১৮ বছর’ পূর্তিতে বিশেষ আয়োজনকে সামনে রেখেই এই মাইলফলক স্পর্শ করলেন। তাকে শ্রদ্ধা করি। আগেও দিদির অনেক নাটক দেখেছি। তবে ৪০০তম নাটকে নিশ্চয়ই তিনি আরো বেশি পরিণত। সেটা দেখতেই বসলাম। যদি খারাপ হয় একেবারে যাতা লিখবো।

আমার ঠোটকাঁটা ‘গল্প নয়’ নাটকের নামেই একটা ধাক্কা আছে, যারা বোঝার তারা ঠিকই বুঝে নেবেন। আসলেই গল্প নয়, নাকি পুরোটাই গল্প সেই বয়ান দেখতে টেলিভিশন সেটের সামনে বসা। খারাপ হলে আমি কি দিদির বিরুদ্ধে লিখবো। হে লিখবো, কেন খারাপ গল্প দিয়ে তিনি আমরা সময় কেড়ে নেবেন!

কভিড-১৯ আক্রান্ত একজন মানুষ ‘গল্প নয়’ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। যেখানে আমরা দেখি আসিফ চরিত্রে অনবদ্য আনিসুর রহমান মিলনকে। করোনা পজিটিভ হয়ে আইসোলেশনে থেকে খবরটি জানান তার স্ত্রী রুপাকে। রুপা মানে আমাদের সেই চেনামুখ জাকিয়া বারী মম। মিলন ভাই আমাদের নাট্যঙ্গণে কেন অপরিহার্য সেটা এই নাটকে আরও একবার প্রমাণ করেছেনে এখানে। কি এক্সপ্রেশন!

তার মুখ দেখেছেন। কি করে এমন করে মুখ কালো করেন আপনি? নমস্য মিলন ভাই। আর জাকিয়া বারী মম, আমি ওনাকে লাক্স চ্যানেল আই সুপারর্স্টার প্রতিযোগিতার সেরা আবিষ্কার মনে করি। লাক্স না থাকলেও তিনি আসতেন নাট্যঙ্গণে। ওনার গলার সাউন্ড শুনছেন। সাউন্ড দিয়ে তিতিন অভিনয় তোলেন। আনাড়ীরা বুঝবেন না।

তবে কভিড-১৯ আক্রান্ত স্বমী আসিফের করোনা পজিটিভ খবর শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি রুপা। পরে যখন সত্যটা মেনে নিতে হলো তখন আর তার কাছে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না রুপার। ভার্চুয়াল যোগাযোগ চলে দুজনের। যেখানে স্বামী-স্ত্রী রসায়নে দর্শকদের মুগ্ধ করতে পেরেছেন মিলন-মম। তবে স্বামীর কভিড পজিটিভ হওয়ার খবর তিনি তার নিজের মা-বাবার কাছেও গোপন রাখেন। এখানেই গল্প। এটাই ক্লাসিক খেলা।

যেটা চয়নিকা দিদি খেলেন। অনেকটা সাকিব তামিমের মতো। মমর বাবা কারণ দুজই উচ্চ রাক্ত চাপের রোগী। তবে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মাকে দেখে আসেন রুপা। সন্তান হয়েও দরজা থেকেই মাকে দেখে বিদায় নেন। চোখ ভাসান অতিমারিতে। শরীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও অসুস্থ বাবা মাকে স্বমীর অসুস্থতার কথা না জানানো। দারুনভাবে মহামারির মেসেজ থ্রু করেছেন চয়নিকাদি।

করোনা সময়ের সবচেয়ে আলোচিত খবর হলো চিকিৎসা না পেয়ে মানুষের মৃত্যু। মমর পিতা মাতাকে এই বিপর্যয়ে নিয়তই ভেঙ্গে যেতে দেখা গেছে। করোনায় বিপর্যয়ে ঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে তার বন্ধু মারা গেছে এমন খবরই আসে রুপার বাবার কাছে। করোনার দুর্দশার খবর ডর ভয়হীন প্রকাশ করেছেন নির্মাতা।

আর এই বিপর্যয়ে রুপার বাবা নিজেদের ব্যাংকের জমানো টাকা থেকে মানুষকে সহায়তা করার পরিকল্পনা করেন। যেখানে একটি ডায়ালগ থাকে অনেকটা এমন। যদি বেঁচেই না থাকি এই টাকা দিয়ে কি হবে? এমন মানবিক ঘটনা করোনার সময়ে অনেক ঘটেছে। সেসবই সম্ভবত ফারিয়া হোসেনকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছে। আর মাসুম বাশার মিলি বাশার এই দুজন মানুষের চেহারা খোদার তৈরি প্রাকৃতিক অবয়ব। যা করেন তাই ভাল লাগে।

তাই আর তাদের বিষয়ে বাড়িয়ে না বলি। শুধু বলবো আপনারা মুগ্ধ করে চলেছেন বহুদিন ধরে। অন্যদিকে আসিফের বন্ধু ইরফান সাজ্জাদ ফোন করে জানান তার বাবা কভিড-১৯ পরীক্ষায় দুবার নেগেটিভ হওয়ার পরও তাকে জোর করে আইসোলেশনে রেখেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে ওই হাসাপাতালের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় তার সুস্থ বাবার।

ইরফান সাজ্জাদ এই খবর বন্ধু আসিফকে (মিলন) জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ইরফান সাজ্জাদ প্রতিনিয়ত নিজেকে ভেঙ্গে গড়ে চলেছেন সেটাও আরো একবার দেখা গেলো ‘গল্প নয়’ নাটকে। বন্ধুকে আসিফ নতুন পৃথিবীর সান্তনা দেন পৃথিবী একদিন ঠিকই বদলে যাবে। কিন্তু আমরাতো দেখছি আমাদের দেশের স্বাস্থখাত থেকে কোনো খাতই এতোবড় বিপর্যয়ে মানুষ হলো না।

সম্ভবত অতি-সম্প্রতি বাংলাদেশে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়েই গল্পটি লিখেছেন ফারিয়া হোসেন ও চয়নিকা দিদি। যে কারণে নাটকের নাম করণেও ছিল সেই ইঙ্গিত। গল্প নয়।

অসুস্থ আসিফ আরো অসুস্থ হতে থাকে, এরই মধ্যে নিজের বাবার সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্বটা মেটানোর চেষ্ট করে। আসিফ ধরেই নিয়েছে তার নিশ্চিত যাবার সময় হয়েছে। বাবাকে ফোন করে। স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য ধরে রেখে নিজের সন্তানের সঙ্গে যে মানুষটি কথা বলেন তিনি আসিফের বাবা। দর্শকদের কাছে তিনি আবুল হায়াত। আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনের এক কিংবদন্তি। অনেকদিন পর এমন একজন মানুষেকে কেমন দেখাবে সেটাও দর্শক হিসেবে আমার কাছে দারুন আগ্রহের।

তবে সন্তানের কথোপকথনের এক পর্যায়ে তিনি যখন জানলেন ছেলে তার করোনা পজিটিভ, তখন আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। ছেলেকে চিকিৎসা করানোর সাহস দেন। ছেলে জানান এর তো কোনো চিকিৎসা নেই বাবা। আসিফ যখন গুরুতর অসুস্থ সেসময় তাকে ফোন করে ভিডিও কলে আসতে জানায় রুপা। দুজনের আবেগঘন কথোপকথনে অনেকেই হয়তো আপ্লুত হয়েছেন।

আসিফ নিজের অনুস্থতা হাচি খাঁশি লুকাতে চায়। তবে যখন জানতে পারেন তিনি সন্তান বাবা হবেন, তখন তিনি বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। কিন্তু বেঁচে থাকার সম্ভাবনা যেখানে ক্ষীণ তাই তিনি স্ত্রী রুপাকে বলেন, তবু যেন আছি, প্রতিদিন যখন রোদ আসবে তখন সেই রোদই হবো আমি। যে বাতাস তোমার চুলকে এলেমেলো করবে, সেই বাতাসেই থাকবো আমি, আমি থাকবো বৃষ্টির ফোটায়।’ তারপরই আসিফ জানায় আমি মরে গেলে সন্তান পেয়ে আমায় ভুলে যেও না। এমন কথায় কোনো মানুষই হয়তো কান্না আটকে রাখতে পারবে না।

একজন সুস্থ মানুষকে কায়দা করে হাসপাতালে রেখে অনৈতিকভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার যে পায়তারা, আবার সেই মানুষটিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া, কি দারুন ভার্চুয়াল বয়ান। সেটি নিঃসন্দেহে সাহসী। পরিচালক সম্ভবত যা দেখেন সেটা দর্শককে দেখাতে পারার মধ্যেই স্বার্থকতা খুঁজে পান। সেই হিসেবে “গল্প নয়” দারুন একটি জিনিস আমাদের উপহার দিয়েছেন চয়নিকা দিদি। করোনার প্রতিবন্ধকতা না থাকলে আমরা হয়তো এর চিত্রায়নে আরো অভিনভত্ব দেখতে পেতাম। তারপরও যা হয়েছে সেটাই বা কম কিসে।

তখনই বাজতে থাকে… অরুণ দার (অরুণ চৌধুরী) “আকাশের আলো জানান দেবে, জীবন সুন্দর সবকিছুর পরে” নাটকে ঘুরে ফিরে এই গানটা গল্পকে প্রাণবন্ত করেছে। তনাভীর তারেক ভাই যার কাড়িগর। এমন সুন্দর একটি লিরিককে তানভীর ভাই জীবন্ত করে তোলেন। তিনি ওস্তাদ লোক। বহুদিন ধরে চিনি মানুষটাকে। তার সুর শুনে নিশ্চয়ই ভাবনায় আসতে পারে কে লিখেছেন এটা।

লিরিকটি খ্যাতিমান সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র ও নাট্য নির্মাতা অরুন চৌধুরী লেখা। অরুণদা আমার গুরু স্থানীয়। নাটকে গানের ব্যবহারে তারচেয়ে পারঙ্গম লোক এই দেশে খুব কম আছে। সংগীতে দাদার দখল আমাকে মুগ্ধ করেছে অনেক আগেই। যথারীতি সন্ধিদার’র আবহ সংগীত ছিলো অনবদ্য।তিনি ওস্তাদ মানুষ। আপনার ১০০০ হাজার নাটক পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাই দিদি। সুস্থতা ও সুস্বাস্থ নিয়ে বেঁচে থাকুন।

নাটকটির রিভিউ লিখেছেন সৈয়দ ঋয়াদ।

নাটকটির ইউটিউব লিংক নিচে দেওয়া হলো-

https://youtu.be/MF66MWeWyvM

Ad