ষাট পেরিয়ে নীনাগুপ্তা

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : এই সময়ে এসে কন্টেন্ট নির্ভর বলিউডে সব বয়সী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জন্য আলাদাভাবে শক্তিশালী ক্যারেক্টর নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে। আর প্রধান নায়ক বা নায়িকাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই ক্যারেক্টরে অভিনয় করা শিল্পীরাও নিজেদের সবটা দিয়ে স্বতন্ত্র একটি ছাপ রেখে যাচ্ছে। বলিউডে আজ যেকোনো প্রতিভাবান শিল্পী সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের দক্ষতার প্রমান দিয়ে যাচ্ছে। যে কয়জন অভিনেতা-অভিনেত্রী এই সময়ে এসে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ইনিংস সফলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম নীনা গুপ্তা। জন্মদিনে এই গুনী শিল্পীকে নিয়ে এসকে মিডিয়ার বিশেষ ফিচার।

১৯৫৯ সালের ৪ই জুলাই জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন অভিনেত্রী, নির্মাতা নীনা গুপ্তা আজ ভারতীয় চলচ্চিত্রের অন্যতম দক্ষ এবং জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক ভিন্ন উচ্চতায়। যদিও ১৯৯৪ সালে ’ওহ ছোকরি’ সিনেমার জন্য সেরা সহ-অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেছিলেন। কিন্তু ওই সময় বলিউডে একটা নির্দিষ্ট বয়সের পরে বিদায় নেবার চল ছিল বিশেষ করে ক্যারেক্টার শিল্পীদের জন্য এটা একরকম বাধ্যতামূলক ছিল।

ছোট ছোট চরিত্র যেগুলো তেমনভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা সেরকম চরিত্রে তারা ডাক পেতেন বটে তবে নীনা গুপ্তা কখনোই এমন চরিত্রে অভিনয় করতে চাননি। ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচিত মানুষের অভাব ছিলনা তবে কাজের জন্য কখনো কারো কাছে যাননি নীনা। তাই ঠিক যতটা খ্যাতি বা জনপ্রিয়তা প্রাপ্য ছিল তা হয়তো তখন পাননি কিন্তু বলিউডে নতুন ট্রেন্ড চালু হবার পরে নিজের সহজাত অভিনয় প্রতিভা এবং হার না মানা মনোভাব তাকে আবারো নিয়ে এসেছে আলোচনায়।

নীনা গুপ্তা তার সময়ে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৮২ সালের ‘গান্ধী’ চলচ্চিত্রে তিনি মহাত্মা গান্ধীর নাতনীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। এছাড়াও, মার্চেন্ট আইভোরি ফিল্মসের দ্য ডিসিভার্স (১৯৮৮), মির্জা গালিব (১৯৮৯), ইন কাস্টোডি (১৯৯৩), কটন মেরি (১৯৯৯) তার অভিনীত চলচ্চিত্র গুলোর মাঝে অন্যতম।

১৯৯৩ সালে ‘খলনায়ক’ চলচ্চিত্রে মাধুরী দীক্ষিতের সাথে একটি গানে তার পারফরম্যান্স এখনো জনপ্রিয়। বলিউডের সংগীত ইতিহাসের অন্যতম কালজয়ী গান ‘চোলি কি পিছে’ গানে তার অংশগ্রহন আলোড়ন তুলেছিল। এছাড়া নব্বই দশকে টেলিভিশনে শ্রীমান-শ্রীমতি আইরিয়ালে অভিনয় করে রাতারাতি জনপ্রিয় তারকা হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। ছোট পর্দার জন্য টেলিফিল্ম ‘লাজোয়ান্তি’ ও ‘বাজার সীতারাম’ নির্মাণ করেছিলেন তিনি। ‘বাজার সীতারাম’ ১৯৯৩ সালে সেরা প্রথম নন-ফিচার চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে।

ব্যাক্তিগত জীবনে ১৯৮০-এর দশকে সাবেক বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটার স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডসের সাথে সংক্ষিপ্তকালের জন্য গভীর ভালোবাসার সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন নীন। ফলশ্রুতিতে এখনকার ফ্যাশন ডিজাইনার মাসাবা গুপ্তা (কন্যা সন্তানের) জননী হন তিনি। এবং তখনকার সময়ে বিয়ে না করেই মা হবার কারনে বলিউডে খুব কম কাজই পেয়েছেন এই অভিনেত্রী। কাজ কম পাবার কারণ বলতে গিয়ে বিস্ফোরক কিন্তু সত্য মন্তব্য করেছেন নীনা।

তিনি জানিয়েছেন, বিয়ে না করে মা হয়েছিলেন বলেই তাকে অনেকেই কাজ দিতে চায়নি। অবিবাহিত অবস্থায় মা হওয়ার জন্য অনেকটাই মনের জোরের দরকার। আর আমার এই চরিত্রের কারণেই আমার কাছে যে অভিনয়ের অফার গুলি এসেছিল সবই খলনায়িকার। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল সেসব চরিত্রে অভিনয় করার মতো প্রতিভা আমার ছিলনা। তাই অনেকদিন অভিনয় থেকে দুরে ছিলেন তিনি। বিশ্বখ্যাত ক্রিকেটার ভিভ রিচার্ডসের সন্তানের মা নীনা গুপ্তা। কিন্তু প্রথম জীবনে সেই স্বীকৃতি ভিভ রিচার্ডস তাকে দেননি। পরে মেয়ে মাসাবার উদ্যোগেই ভিভ তাকে পিতার স্বীকৃতি দেন।

নীনা গুপ্তা কিন্তু ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে তার সম্পর্ক কখনো গোপন রাখেননি। গোটা বলিউডই জানত। সে সময়ে বিয়ে না করে মা হওয়ার ভাবনা চিন্তাই কোনো মেয়ে করতে পারতেন না। নীনার এই সিদ্ধান্ত দর্শকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে ভেবেই পরিচালকরা তাকে খুব একটা অভিনয়ের অফার দিতেন না বলে জানিয়েছেন নীনা।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ১৫ই জুলাই দিল্লিভিত্তিক চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ও পিডব্লিউসি ইন্ডিয়ার অংশীদার বিবেক মেহরার সাথে যুক্তরাষ্ট্রে গোপনীয়ভাবে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন। অনেকটা সময় পার হয়ে যাবার পরে আচমকাই একদিন একটি টুইট করেছিলেন নীনা- ‘আমি একজন অভিনেত্রী, এবং আমি মুম্বাইয়ে থাকি, যদি আমার যোগ্য কোন চরিত্র থাকে তাহলে আমাকে অভিনয়ের জন্য ডাকতে পারেন।’

কিছুটা ক্ষোভ এবং অভিমান নিয়েই তিনি টুইটটি করেছিলেন বলে পরে জানা যায়। এরই ফলশ্রুতিতে একদিন ‘বাধাই হো’ সিনেমার জন্য অফার পান তিনি। তারপরের কাহিনীটা সবার জানা। বক্স অফিসে সুপার ডুপার হিট ব্যবসা করে ‘বাধাই হো’। এই সময়ের ক্রেজ আয়ুস্মান খুরানা তো প্রশংসিত হন এই সিনেমায়। তবে দর্শকদের হৃদয়ে দাগ কাটেন মাঝবয়সী পিতা-মাতার চরিত্রে অভিনয় করা গজরাজ রাও এবং নীনা গুপ্তা।

উল্লেখ্য ‘বাধাই হো’ ছবিতে জুটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন নীনা গুপ্তা ও গজরাজ রাও। এবং শুরুতেই বাজিমাত, সবার কেড়েছিল এই আনকোরা জুটি। নিজেদের ছেলের বিয়ের কথা চলার সময় নতুন সন্তান আগমনের বার্তা নিয়ে লজ্জা, ভালোবাসা, ত্যাগ সহ অনেক রকম অনুভূতি ভর করে এগিয়ে যাওয়া পিতা-মাতার চরিত্রে বলা যায় চুটিয়ে অভিনয় করেন নীনা-গজরাজ। এই সিনেমার কল্যানে এতো বছরের ক্যারিয়ারে নীনা গুপ্তা প্রথমবার লাভ করেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কার।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে নীনা গুপ্তার জনপ্রিয়তা বা দক্ষতা নিয়ে নতুন করে আর প্রমাণ করার নেই। রসবোধেও তাঁকে টেক্কা দেওয়া বেশ কঠিন। আর যতই বয়স বাড়ছে, তিনি যে স্টাইলে আজও পিছিয়ে নেই সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছেন নীনা গুপ্তা। প্রায়ই ডিজাইনার মেয়ে মাসাবা গুপ্তার ডিজাইন করা ড্রেস পরে মাত করেছেন দর্শকদের। এছাড়াও তাঁর ইনস্টাগ্রামে চোখ রাখলেই দেখা যায় ক্যাজুয়াল পোশাকেও একই ভাবে সাবলীল ৬০ বছরের অভিনেত্রী। আর তার সঙ্গে মানানসই মজাদার ক্যাপশনও দেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলা ‘ফ্রক কা শখ’ ছবি পোস্টের পরেই হইচই বেঁধে যায়।

৬০ বছর বয়সের এক ভারতীয় অভিনেত্রীর ফ্রক পরিধান করা ছবি ঝড় তোলে সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারপর কিছুদিন আগেই লন্ডনের রাস্তায় গজরাজ রাও ও নিনা গুপ্তার একটি পোস্ট সকলের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। নিনা গুপ্তা তাঁর ও গজরাজের ছবি ইনস্টা হ্যান্ডেলে পোস্ট করে লিখেছিলেন, “আমি যেখানেই যাই সেখানেই তুমি চলে আসো।”

ক্যারিয়ারের এই সময়ে এসে কীভাবে এমন ছকভাঙা অনস্ক্রিন কেমিস্ট্রি তৈরি হলো? সম্প্রতি এমন প্রশ্নের জবাবে নীনা বলেন, “গজরাজ শুরুতে খুবই রিজার্ভড থাকত। চুপচাপ থাকত। সিনের সময়ে প্রতি পদে আমার অনুমতি নিত! কখনো বলত নীনাজী আপনার কোলে এভাবে মাথা রাখব? এটা এভাবে করতে পারি… সত্যি বলতে কী প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত লাগত আমার।” সঙ্গে যোগ করেন, “তারপর যখন একসঙ্গে রিহার্সাল করা শুরু করি, আমাদের মধ্যে আড়ষ্টতা এবং অস্বস্তিও কমতে থাকে। এখন তো সেটে সর্বক্ষণ হাসি ঠাট্টা করে যাই। মানসিক এবং শারীরিকভাবেও একে অপরের সঙ্গে খুবই কমফোর্টেবল আমরা। আর এই কমফোর্টটাই স্ক্রিনে ফুটে ওঠে।”

সেই জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই মুক্তিপ্রাপ্ত ‘শুভ মঙ্গল জ্যায়দা সাবধান’ সিনেমাতে দুই বর্ষীয়ান অভিনয় শিল্পীকে আবারো জুটি বেধে অভিনয় করতে দেখা গেছে। এক সমকামী ছেলের বাবা-মা হিসেবে এই সিনেমাতেও তাদের অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছে সবার। এই সিনেমাতেও মূল চরিত্রে আছেন আয়ুস্মান খুরানা। ‘শুভ মঙ্গল জ্যায়দা সাবধান’ ছবিতে সুনয়নার চরিত্রে দেখা যাবে নীনা গুপ্তাকে। আর এর জন্য অভিনয়ে বেশ কিছু রদবদল এনেছেন নীনা। বদলেছেন কথা বলার ধরনও। এসব কিছু দর্শকদের কাছে এক অন্য নীনা গুপ্তাকে হাজির করেছে বলে মনে করেন তিনি।

গতবছর তার অভিনীত ‘দ্যা লাস্ট কালার’ সেরা ফিচার ফিল্ম বিভাগে অস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল। কিছুদিন আগে মুক্তিপ্রাপ্ত অশ্বিনী আইয়ার তিওয়ারির ‘পাঙ্গা’ সিনেমায় তার অভিনয় সুনাম কুড়িয়েছে। সামনে আসছে রোহিত শেঠির ‘সূর্যবংশী’। এই সিনেমায় অক্ষয় কুমার এবং ক্যাটরিনা র সাথে স্ক্রিন শেয়ার করেছেন তিনি।

ষাট বছর পার করে আসা এই অভিনেত্রী তার ফ্যাশন সেন্স, সময়ের সাথে খাপ খাইয়ে চলার মনোভাব এবং অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা এখনো ষোলো বছরের তরুনীর মতো আছে বলেই জানান নীনা গুপ্তা। সুন্দর সুন্দর চরিত্রে অভিনয় করে যেতে চান আজীবন। বদলে যাওয়া বলিউড তার সেই অধরা স্বপ্নগুলো সত্যি করেছে বলে কৃতজ্ঞ তিনি। সকলের ভালোবাসা আর সহযোগিতা তাকে নিয়ে যাবে আরো অনেকদূর এমনটাই আশা করেন তিনি।

Ad