অভিনয়ের জাদুকর আফরান নিশো

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির একমাত্র অভিনেতা যাকে দর্শকরা কোন চরিত্রে দেখেনি সেটা বলা মুশকিল, হোক গ্রামের সহজ সরল যুবক, বা পরিশ্রমী একজন মাঝির চরিত্র, একজন লিফটম্যান, একজন পাগলের চরিত্র, হকার বা ফেরিওয়ালার চরিত্র, কিংবা মোবাইল মেকানিক্যাল, বা গ্যাং লিডার, একজন প্রেমিক, বেকার যুবক বা রোমান্টিক স্বামী বা বাচ্চা চুরির দলের সদস্য সব ধরনের চরিত্রে নিজেকে উজার করে দেন এই অভিনেতা। তার সহজাত অসাধারণ এবং ন্যাচারাল অভিনয় মন জয় করে সবারই। বলা হচ্ছে এই সময়ের জনপ্রিয় এবং দক্ষ অভিনেতা আফরান নিশোর কথা।

আফরান নিশো সব শ্রেণীর দর্শকের কাছে একজন প্রাণবন্ত ও বৈচিত্রময় অভিনেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার অভিনয় দক্ষতা এবং কঠোর পরিশ্রম দিয়ে। বর্তমানে তার সফলতা আকাশ ছোয়াঁ। একজন ভার্সেটাল অভিনেতা হিসেবে এই সময়ে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে সফল অভিনেতা তিনি। সময়ের সাথে সাথে নিজেকে নিয়ে আরো বেশি এক্সপেরিমেন্টাল কাজ নিয়ে চমকে দিচ্ছেন সবাইকে।

তার স্মার্ট লুক, ইউনিক এবং দুর্দান্ত ভিন্নধর্মী অভিনয় দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে কোটি দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। এখন তাকে দেখে দর্শক আস্থা রাখে যে ভালো গল্প ও ভালো অভিনয় দুটোর সংমিশ্রণ দেখবে তারা। হুমায়ুন ফরিদী, জাহিদ হাসান, মাহফুজ আহমেদ, মোশাররফ করিম, চঞ্চল চৌধুরীর প্রজন্মের পরে আফরান নিশোর মতো ক্যারেক্টারের ভেরিয়েশন তার প্রজন্মের অন্য কেউ সেভাবে দেখাতে পারেনি। যদিও মোশাররফ করিম বা চঞ্চল চৌধুরী এখনো সমান দাপটে কাজ করে যাচ্ছেন তবুও বয়সের কারনে সব চরিত্রে এখন তাদের কাজ করতে দেখা যায়না।

নিশোর পুরো নাম আহমেদ ফাজলে রাব্বি। কিন্তু আফরান নিশো নামেই তিনি সবার কাছে পরিচিত। ১৯৮৮ সালের ৮ই ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর উপজেলার সারন গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহন করেন তিনি। আফরান নিশো ধানমন্ডি সরকারী বয়েস স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন এবং গ্যাজুয়েশান করেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে।

আফরান নিশো কখনো মডেল বা অভিনেতা হবার বা মিডিয়াতে কাজ করার স্বপ্ন দেখেননি। কিন্তু হঠাৎ করেই তার মডেলিংয়ে আসা। ২০০৩ সালে অমিতাভ রেজার বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর মডেল হিসেবে যাত্রা। এরপরে আরো নানা নির্মাতার সাথে নানারকম কাজ করেন নিশো এবং একই বছর আফজাল হোসেনের প্রতিষ্ঠান টকিজে একদিন স্ক্রিন টেস্ট দেন এবং টেস্ট কমপ্লিট করে থাইল্যান্ডে গিয়ে ডাবল কোলা ব্র্যান্ডের জিনি জিনজার ফ্লেভারের একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে অংশ নেন তিনি। এরপরে গাজী শুভ্র, গোলাম হায়দার কিসলু, কিরন মেহেদী সহ খ্যাতনামা অনেক পরিচালকের বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। মডেল হিসেবে জনপ্রিয় এবং গ্রহনযোগ্যতা প্রমান করে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে।

২০০৬ সালে বাংলাভিশানে প্রচারিত গাজী রাকায়েত এর পরিচালনায় ‘ঘরছাড়া’ নাটকের মধ্য দিয়ে প্রথম টেলিভিশান নাটকে অভিনেতা হিসেবে দেখা যায় তাকে। বলা যায় প্রথম নাটকেই সকলের নজর কাড়েন তিনি এবং এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নিশোকে। বর্তমানে বেশকিছু প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন এই জনপ্রিয় অভিনেতা। ২০১৭ থেকে ২০২০ এই তিন বছরের বিশেষ দিন উপলক্ষে যেমন দুই ঈদ বা বৈশাখ অথবা ভালোবাসা দিবসে প্রায় একচেটিয়াভাবে অভিনয় করতে দেখা গেছে নিশোকে। বিগত কয়েকবছরে অগনিত জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে দেশের জনপ্রিয় অভিনেতা হিসেবে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অন্য উচ্চতায়।

অভিনয়কে প্যাশন হিসেবে মেনে চলা এই মানুষটা তার সকল ধ্যান-জ্ঞান অভিনয়ের মাঝেই রেখেছেন। নিত্যনতুন চরিত্রের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছেন তিনি। দর্শকদের রুচি, চাহিদা এবং সময়োপযোগী গল্প মাথায় রেখে কাজ করে চলেছেন অবিরাম। নিজের অভিনয় নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন নিশো, আর স্বপ্ন হলো একদম বাস্তবিক সব ধরনের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে কাজ করতে চান তিনি। কোন একটি চরিত্রে নয় বরং বহুমাত্রিক চরিত্রে অবিরাম অভিনয় করে যেতে চান তিনি।

বিভিন্ন সময় দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, প্রয়াত জনপ্রিয় এবং শক্তিশালী অভিনেতা হুমায়ূন ফরিদীকে আইডল মানেন তিনি। তাই হয়তো হুমায়ূন ফরিদীর পরে তাকেই টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে একজন সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করার মতো শক্তিশালি অভিনেতা হিসেবে গন্য করা হয়।

আফরান নিশো অভিনীত উল্লেখযোগ্য কিছু কাজ হলো- অচেনা মানুষ, স্বপ্নগুলো ইচ্ছে মত, ইডিয়টস, টার্নওভার, ফুলমতি, শুধু তোর জন্য, তুমি না থাকলে, লোটাকম্বল, রেডরোস, বিয়ে পাগল, শেষচিঠি, আকাশের ঠিকানায়, ইঞ্জিন, ধুমকেতু, কংকাবতির চিঠি, প্রেম না দ্বিধা, আবারওদেবদাস, আকাশের ঠিকানায়, এক্স স্কয়ার, হাটবিট, নিখোজ ভালবাসা, সংসার, কমলা সুন্দরী, বাক, ডাইভোর্স, হাওয়াই শহরের গল্প,গুলবাহার, একটি অসমাপ্ত ভালবাসা, ঘুরে দাড়ানোর গল্প, প্রতীক্ষা, হেলফুল সাইফুল, হোমটিউটর, অগোচরে ভালবাসা, জীবন সংগী, কমলার বনবাস, অনুভবে, সহজ সরল ছেলেটা, বুকের বা পাশে, বা সাম্প্রতিক সময়ে ফেরার পথ নেই, ছেলেরাও কাঁদে, লালাই, লায়লা তুমি কি আমাকে মিস করো, উচ্চতর হিসাববিজ্ঞান, দ্যা প্রেস, এই শহরে, ভিক্টিম, ইতি মা, নির্বাসন, উপহার, আগন্তুক, মিস শিউলী, জন্মদাগ ইত্যাদি। সামনে আসছে বিগ বাজেটের ওয়েব সিরিজ ‘মরীচিকা’। এই সিরিযে তার লুক ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হইচই ফেলে দিয়েছে।

জুটি হিসেবে তিশা, মেহজাবীন এবং তানজিন তিশার সাথে বেশিরভাগ কাজ করলেও সিনিয়র অভিনেত্রী অপি করিম হোক বা জুনিয়র তাসনিয়া ফারিন সবার সাথেই তাকে মানিয়ে যায় সুন্দরভাবে। একটা সময় রোমান্টিক নাটকে একচেটিয়া অভিনয় করলেও আস্তে আস্তে সব ধরনের চরিত্রেই নিজের অভিনয় দক্ষতা তুলে ধরেছেন তিনি।

বিশেষ করে বিগত কয়েকটি ঈদে তার অভিনীত কিছু নাটক অসামান্য প্রশংসা পেয়েছে। একজন অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রমানের খেলায় আফরান নিশো যে অন্যন্য এক উচ্চতায় নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এই সময়ের ভার্সেটাইল অভিনেতা বললে সবার আগে তার নামটাই মাথায় আসে।

তার ভয়েস, ডায়লগ ভেলিভারি, যেকোনো চরিত্রে নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নেবার ক্ষমতা তাকে আজ দেশের টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির সেরা জনপ্রিয় অভিনেতার খেতাব এনে দিয়েছে। একজন প্রতিভাবান অভিনেতা হিসাবে সবার মাঝে টিকে থাকতে চান আফরান নিশো। দর্শক বা ভক্ত হিসেবে আমরাও চাই তিনি ভিন্নধর্মী গল্প নতুনত্ব নিয়েই কাজ করে যাবেন। শুভ কামনা রইলো এই গুনী অভিনেতার জন্য।

Ad