মোশাররফ এবং রওনকের নান্দনিক ‘হ্যামলেটের ফিরে আসা’

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : আমাদের দেশের একজন দক্ষ এবং শক্তিশালী অভিনেতা মোশাররফ করিম। মাঝে কিছুটা সময় অনেক নাটকে তার উপস্থিতি বা অভিনয় ভালো না লাগা বা মেনে নিতে না পারলেও বেশ কিছুদিন ধরেই আবারো ভিন্নধর্মী এবং ব্যতিক্রমী কনটেন্টে তার উপস্থিতি আমাদের স্বস্থি দিচ্ছে।

অন্যদিকে ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় এদেশে আন্ডাররেটেড যে কয়জন দক্ষ অভিনেতা আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন রওনক হাসান। এতো গুনী একজন অভিনেতাকে আমাদের নির্মাতারা সেভাবে কাজে লাগাননি এবং এখনো ওইভাবে তাকে নিয়ে ভিন্নধর্মী কাজ হচ্ছেনা এই ব্যাপারটা মেনে নেয়াটা কষ্টকর।

তাই মোশাররফ করিম এবং রওনক হাসানের যুগলবন্দী ‘হ্যামলেটের ফিরে আসা’ নাটক নিয়ে যেরকম একটা আগ্রহ ছিলো এই দুজন অসাধারণ অভিনেতার অভিনয় দক্ষতা এবং ভিন্নধর্মী গল্পের কারনে সেটি পূরন হয়েছে শতভাগ।

বিখ্যাত লেখক শেক্সপিয়ারের অমর সৃষ্টি ‘হ্যামলেট’ আমাদের দেশের একটি নাটকে এমনভাবে উঠে আসবে তা ছিলো কল্পনার বাইরে। উপন্যাসটি আগেই পড়া ছিলো তাই হয়তো এই নাটকের সাথে মিশে যেতে একদমই কষ্ট হয়নি। এছাড়া আমি একটা সময় মঞ্চে প্রচুর নাটক দেখার কারনে মঞ্চ নাটকের প্রতি আলাদা একটা টান আছে সেইজন্য এই নাটকের গল্প বা কনটেন্ট এর সাথে খুব সহজেই রিলেট করা গেছে।

অসাধারন স্ক্রিপ্ট, সুন্দর সংলাপ, নির্মানের মুন্সিয়ানা এবং দুই তুখোড় অভিনেতার মন কেড়ে নেয়া অভিনয় সব মিলিয়ে ‘হ্যামলেটের ফিরে আসা’ সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা একটি কাজ এই কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। মিথ্যা বলবোনা পরিচালক আশরাফুজ্জামান নামটি আমার কাছে অপরিচিত। আগে উনার কোনো কাজ দেখে থাকলেও হয়তো নামটি খেয়াল করা হয়নি।

তবে এই নাটকে তিনি প্রমান করেছেন গল্পের ভিন্নতা, স্ক্রিপ্টের জোর, শিল্পীর মেধা এসব কিছুর সংমিশ্রণে অল্প টাকায় অনেক ভালো কাজ উপহার দেয়া যায়। টেকনিক্যাল কিছু বিষয়ে হয়তো আরো একটু ভালো করা যেতো তবে এই কমতি নাটক দেখার পুরোটা সময় মনোযোগী দর্শক হতে বাধা দেয়নি। নাটকের গল্প এবং পরিচালনা দুটো দিকই সামলেছেন আশরাফুজ্জান নিজেই৷

মেহেদী রনির চিত্রগ্রহন ভালো এবং নাটকের পোষ্টার গুলো তারই করা জেনে ভালো লাগছে। নাটকের পোষ্টার গুলো বেশ নান্দনিক কাজ হয়েছে। আবহ সংগীতের দায়িত্বে থাকা এস আই টুটুলের কাজ ভালো লেগেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্যুটিং হয়েছে বেশিরভাগ অংশের। সেট না বানিয়ে রিয়েল লোকেশনে কাজ করাটাও চোখে স্বস্থি দিয়েছে।

যেকোনো নাটক বা সিনেমার সফল প্রোডাকশন হিসেবে প্রমানিত হবার পেছনে একটা বড় বিষয় হচ্ছে একেবারে শেষ পর্যন্ত এন্ডিংয়ের সাসপেন্সটা ধরে রাখা। কি হবে? ঘটনা কি? কে দোষী? এসব প্রশ্নের উত্তর সম্পর্কে যেনো দর্শক নিশ্চিত না হতে পারে থ্রিলার বা সাসপেন্স ঘরানার ফিকশনে এটা খুব জরুরি। সেই দিক থেকে ‘হ্যামলেটের ফিরে আসা’ পুরো সফল। গল্পের মোড়, সংলাপের গভীরতা এবং অভিনয় দক্ষতা দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট আমাদের বেধে রেখেছে ‘হ্যামলেটের ফিরে আসা’।

নাটকে মোশাররফ করিম ভালো অভিনয় করলেন না রওনক হাসান তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে কারন দুজনেই এতো অসাধারণ সুন্দর অভিনয় করেছেন যে ‘শ্যাম রাখি না কূল রাখি’ টাইপ অবস্থা আমার। আশাকরি এই নাটকের পর আমাদের গল্পকার এবং নির্মাতারা একটু নতুন করে ভাববেন আমাদের দেশের শক্তিশালী এবং দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে।

গতানুগতিক বা গৎবাধা কাজের বাইরে এখন বেশ কয়েকজন নির্মাতা ভিন্নধর্মী সাবজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন এবং আশার কথা হচ্ছে দর্শকেরা এসব কাজ সাগ্রহে গ্রহন করছে। ‘ইতি মা’ ‘আমাদের সমাজ বিজ্ঞান’ ‘ভিক্টিম’ ‘আড়াই মন স্বপ্ন’ ‘বোধ’ ‘জন্মদাগ’ ‘ইরিনা’ র পথ ধরে ‘হ্যামলেটের ফিরে আসা’ নাটকটিও ভিন্নতার একটি উদাহরণ তৈরী করলো।

তবে ভালো নাটক চাই, ভালো নাটক চাই বলে যারা আফসোস করেন তারা কয়জন নাটকটি দেখছে এটাও বড় প্রশ্ন। কারন এই সময়ে এসে ইউটিউবের ভিউয়ের উপর নাটকের কিছু বিষয় নির্ভয় করে একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। বিশেষ করে কতোজন দর্শকের কাছে নাটকটি পৌছালো এটা অন্তত বোঝা যায়।

সেই সমীকরণে এই নাটকটি বেশ পিছিয়ে। কেন পিছিয়ে তা হয়তো আমাদের বোঝে আসবে না তবে পরিচালক, মোশাররফ করিম, রওনক হাসান সহ পুরো টিমের প্রতি রইলো অভিনন্দন এবং শুভকামনা। সামনে গতানুগতিকের বাইরে এসে তারা আরো অনেক ব্যতিক্রমী কাজ উপহার দিবেন সেই প্রতীক্ষায় রইলাম।

Ad