সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে সাত নির্মাতার ‘রণযোদ্ধা’

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : মিডিয়ার কল্যানে আমাদের সকলেরই জানা যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও একজন বীরাঙ্গনাকে নিয়ে একটি সিনেমা নির্মান হতে যাচ্ছে। ‘রণযোদ্ধা’ নামের এই সিনেমাটি নির্মিত হলে স্বাধীনতার ৫০ তম বছরে এসে আমাদের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে প্রথমবারের মতো এরকম একটি সিনেমা দেখার সুযোগ পেতে যাচ্ছে পুরো জাতি।

এর আগে সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য, নাটক, ডক্যুমেন্টারি হলেও পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মিত হয়নি। সবকিছু ঠিক থাকলে এটি বাংলাদেশের বীরশ্রেষ্ঠদের নিয়ে প্রথম সিনেমা হবে। যে সিনেমার মাধ্যমে এক ক্যানভাসে সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের গল্প দেখতে পাবো আমরা।

ভারতে কারগিল যুদ্ধকে ভিত্তি করে খ্যাতনামা নির্মাতা জেপি দত্ত বলিউডের বেশ কিছু তারকা শিল্পীদের নিয়ে ‘বর্ডার’ এবং ‘এলওসি কারগিল’ নামক সফল এবং নান্দনিক সিনেমা বানিয়েছেন। কিছুদিন আগে সার্জিকাল স্ট্রাইক নিয়ে বলিউডের আরেক সাফল্যগাথা ‘উরি- দ্যা সার্জিকাল স্ট্রাইক’ বক্সঅফিস এবং সাধারণ মানুষের মন দুটোই জয় করেছে।

এছাড়া কিছুদিন আগে ভিন্ন ভিন্ন পরিচালকের ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে আমাদের দেশের এন্থলজি সিনেমা ‘ইতি তোমারই ঢাকা’ ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। ‘রণযোদ্ধা’ ও তেমনিই ধারার সিনেমা হতে যাচ্ছে, যেটাতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের সাত বীরশ্রেষ্ঠের জীবনের না বলা, না জানা অনেক গল্প তুলে ধরা হবে। তাদের পরিবার, দেশের জন্য ভালোবাসা, ত্যাগ ইত্যাদি অনেককিছুই তুলে ধরা হবে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে।

যেহুতু মূল সময়টা মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সাল তাই একই কাহিনিতে সাত বীরশ্রেষ্ঠের ৭টি গল্প সমান্তরালভাবে সিনেমাতে দেখানো হবে। ৭ জন পরিচালক এই সাতটি গল্প উপস্থাপন করবেন। সাতজন পরিচালক হলেন কাওসার মাহমুদ, সানী সানোয়ার, রাশিদ পলাশ, গৌতম কৈরী, কামরুল রিফাত, রাইসুল ইসলাম অনিক এবং সাকিব সনেট। ‘নোলক’ খ্যাত প্রযোজক এবং পরিচালক সাকিব সনেট এবং রাশিদ পলাশ পরিচালনার পাশাপাশি ‘রণযোদ্ধা’ সিনেমাটির প্রযোজক হিসেবেও যুক্ত রয়েছেন।

অন্যদিকে পরিচালনার পাশাপাশি সিনেমার চিত্রনাট্যর দায়িত্বে আছে গৌতম কৈরী। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, ‘রণযোদ্ধা’ কোনো বায়োপিক নয়। আমাদের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্বের গল্পই দেখানো হবে। এর মধ্যে চিত্রনাট্যর চাহিদা অনুযায়ী তাদের পরিবারের গল্প থাকবে।

তিনি আরো জানান, এসব তথ্য সামরিক বাহিনী ও বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবারর সদস্যদের কাছ থেকে নানা তথ্য ইতিমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জার্নাল, বই, নিউজপেপার থেকেও অনেক তথ্য, বিবরণ সংগ্রহ করা হয়েছে।

দেড় বছর আগে সিনেমাটি নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করা হয়েছিলো। বর্তমানে প্রি-প্রোডাকশনের কাজ চলছে। সেই অস্থির সময়টা সেলুলয়েডে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন পুরোটিম। যদিও এখনো কোন বীরশ্রেষ্ঠের গল্প কে পরিচালনা করবেন তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলেই জানিয়েছেন তারা৷

এই বিষয়ে সিনেমার আরেক পরিচালক কাওসার মাহমুদ জান্না, ‘রণযোদ্ধা’ হতে যাচ্ছে একটি পিরিয়ডিক্যাল সিনেমা। আবার সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের গল্প দেখাতে গেলে তাদের ওই সময়ের স্থান, পোশাক, পরিবেশ পরিস্থিতি পর্দায় তুলে আনা বেশ চ্যালেঞ্জিং। তাই ‘রণযোদ্ধা’ সিনেমার গবেষণা দলকে সামরিক বাহিনীর কয়েকজন গবেষক সহায়তা করছেন।

সিনেমার অন্যতম প্রযোজক ও পরিচালক সাকিব সনেট। তিনি জানান সিনেমাটি হতে যাচ্ছে দেশীয় প্রোডাকশন প্রযোজিত সবচেয়ে বড় বাজেটের কাজগুলোর একটি। সাকিব সনেট জানান, ‘আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। তাই মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ নিয়ে আমার অনুভূতি ও আবেগ অন্যরকম। আমরা নবীনরা যে কিছু করতে পারি, সেটাই এই সিনেমার মাধ্যমে দেখাতে চাই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে।

স্পর্শকাতর বিষয়গুলো যেন ঠিক থাকে, সেজন্য একাধিক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের। এই সিনেমাটির মাধ্যমে আমরা মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চাই। আর যেহুতু বিগ বাজেট এবং আজ থেকে ৫০ বছর আগের সময়কে তুলে ধরা হবে তাই প্রস্তুতিও বিশাল। শিল্পীদের সাথে কথা হচ্ছে তবে অফিশিয়াল ঘোষনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে কিছুটা সময়। চুক্তিস্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত কোনো কিছুই আসলে চূড়ান্ত না। তাই এই মূহুর্তে কারো নামই বলতে পারছি না।

‘রণযোদ্ধা’ সিনেমার আরেকটা চমক হচ্ছে, এই সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের গল্পের পাশাপাশি স্থান পাবে একজন বীরাঙ্গনার গল্প। জানা গেছে সিনেমায় বীরাঙ্গনা চরিত্রে অভিনয় করবেন চিত্রনায়িকা ববি। পুরো গল্পে বীরাঙ্গনা চরিত্রটির একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কারন প্রতিটা বীরশ্রেষ্ঠের গল্পের সেতু বা মেলবন্ধন হিসেবে ‘শারমীন’ নামের বীরাঙ্গনা চরিত্রটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধের গল্পে কাজ করা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উচ্ছ্বসিত এই সময়ের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা ববি।

সাতটি গল্প নিয়ে সিনেমা নির্মিত হলেও স্ক্রিনে সব গল্পের সময়সীমা একই রকম হবে ব্যাপারটা তেমন নয়। গল্প, চিত্রনাট্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই সময় পাবেন নিজের গল্পটা তুলে ধরার জন্য। কোন গল্পের জন্য কোন নির্মাতা কতটুকু সময় পাবেন তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকবে বলে জানান পরিচালক কামরুল রিফাত।

তরুন এই মেধাবী নির্মাতারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প সেলুলয়েডে নিয়ে আসার যে ইচ্ছা এবং সেটাকে বাস্তবায়ন করার জন্য নিজের সেরাটা নিয়েই অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সেটা অবশ্যই প্রশংসার দাবীদার।

কারন অন্যভাবে দেখতে গেলে এই সাত শ্রেষ্ঠ সন্তানকে নিয়ে সেভাবে কোনো কাজ এই প্রজন্ম দেখেনি তাই তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধ, ত্যাগ, রক্তক্ষয়ী সেই নয়মাসের যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়কার ক্ষত সম্পর্কে জানানোর জন্য নেয়া উদ্যোগের প্রতি রইলো শুভ কামনা।

নির্মান এবং বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে ‘রণযোদ্ধা’ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি দলিল হিসেবে জায়গা করে নিবে এটাই কামনা।

Ad