নিশো-মেহজাবীনকে নিয়ে ভিকি জাহেদের ‘ভুলজন্ম’

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : গতানুগতিকের বাইরে এসে আমাদের দেশীয় নাটক বা সিনেয়ায় ব্যতিক্রমী কাজ সেভাবে দেখা যায়না বললেই চলে তবে কিছু গুনী নির্মাতা সংখ্যার দিক দিয়ে কম কাজ করলেও ভিন্নধর্মী নানা কনটেন্ট নিয়ে হাজির হচ্ছেন৷ আধুনিকতা এবং টেকনোলজির উপর ভর করে বিনোদনের সংজ্ঞা যেমন বদলে যাচ্ছে তেমনি এসব মানসম্মত নান্দনিক কাজ দর্শকদের কাছেও আলাদা গ্রহনযোগ্যতা পাচ্ছে।

দুই ঈদ, ভালোবাসা দিবস, বৈশাখেই সাধারণত ভিন্ন ভিন্ন গল্প নিয়ে নির্মাতারা কাজ করেন। কারন বিশেষ দিনগুলিতেই দর্শকদের মধ্যেও নাটক বা শর্টফিল্ম দেখার জন্য একটা আলাদা আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। টেলিভিশনের পর্দা ছাড়াও ইউটিউবে অনেকেই নাটক মুক্তি দিচ্ছেন। অন্যভাবে বলতে গেলে বিজ্ঞাপন বিড়ম্বনার কারনে অনেকেই ইউটিউবেই নাটক দেখে নিচ্ছেন।

এছাড়া বিনোদনের নতুন মাধ্যম ওটিটি প্ল্যাটফর্ম তো রয়েছেই। তাই কাজের ক্ষেত্রের সাথে সাথে কাজের সংখ্যাও বাড়ছে সত্যি তবে সেই অর্থে মানসম্মত বা ভিন্নধর্মী কাজ হচ্ছে হাতেগোনা। এই ফাল্গুন এবং ভালোবাসা দিবসে সমস্ত ব্যস্ততা এবং ব্যক্তিগত কিছু দাওয়াত বা গেট টুগেদার সামলে যেকয়টি কাজ দেখার সুযোগ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘ভুল জন্ম’।

এই সময়ে যেকয়জন নির্মাতার কাজ নিয়ে আমাদের সাধারণ দর্শকদের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় তাদের মধ্যে অন্যতম এক নাম ভিকি জাহেদ। তরুন নির্মাতা ভিকি জাহেদ গতবছর ‘জন্মদাগ’ নাটকের মধ্য দিয়ে নান্দনিকতার যে ধারার কাজ উপহার দিয়েছিলেন পরবর্তীতে ‘ইরিনা’ দিয়ে সেই মান বজায় রেখেছিলেন। এবার ‘ভুল জন্ম’ সেই ধারাবাহিকতার নতুন সংযোজন। একটু ব্যতিক্রমী কনটেন্ট, ভিন্নধর্মী নির্মান এবং শিল্পীদের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে গতানুগতিক ধারার বাইরে যেয়েও সফলতা পাওয়া যায় সেটা আবারো দেখালেন ভিকি জাহেদ।

এই সময়ের ছোট পর্দার জনপ্রিয় তারকা জুটি আফরান নিশো ও মেহজাবীন চৌধুরী। জুটি বেধে তাদের কিছু কাজ আপ টু দ্যা মার্ক না হলেও এটাও সত্য যে কিছু কিছু নাটক বা টেলিফিল্মে দুজনের অভিনয় তাদেরকে নতুনভাবে ভালোবাসতে বাধ্য করে। ‘ভুল জন্ম’ নাটকে তারা দুজনেই তাদের সেরা অভিনয় নিয়েই হাজির হয়েছেন। সুযোগ পেলে ভিন্নধর্মী কনটেন্ট দিয়ে আফরান নিশো বা মেহজাবীন যে নিজেদের ছাড়িয়ে যেতে পারেন তা আবারো প্রমানিত হলো। এখন কথা হচ্ছে এদের নিয়ে ভিন্নধর্মী গল্প লেখা বা চরিত্র সাজানো হচ্ছেনা এটা দুঃখজনক।

রোমান্টিক ঘরানার নাটককে পাশ কাটিয়ে ‘এই শহরে’, ‘ইতি মা’ ‘মিস শিউলী’ বা ‘ভিক্টিম’, ‘জন্মদাগ’, ‘মাইনকার চিপায়’ ‘ইরিনা’ ‘কাজলরেখা’ বা এই ‘ভুল জন্ম’ আফরান নিশো যেনো ছাড়িয়ে যাচ্ছেন নিজেকেই। তাকে এই সময়ের অন্যতম সেরা ভার্সেটাইল অভিনেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় সেটা এমনি এমনি নয় তার নতুন প্রমান ‘ভুল জন্ম’।

নিঃসন্দেহে তার এমন গতানুগতিক ধারা ভেঙে মানসম্মত নাটকে অভিনয় তাকে অভিনেতা হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাবে অনেকদূর। বিশেষ করে এই নাটকে শুরুর দিকে কয়েকটা জায়গায় তার ডায়লগ ডেলিভারি এবং লুক বা আরো বিস্তারিত ভাবে বললে সংলাপ বলার সময়ে তার ভ্রু বাকানো আমাকে কিংবদন্তী হুমায়ুন ফরিদীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছে৷ (এটা একান্তই ব্যক্তিগত মতামত, আশাকরি কেউ ব্যক্তিগত মতামত নিয়ে মাথা ঘামাবেন না)

অন্যদিকে এই সময়ে টেলিভিশনে সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। তিনি সুযোগ পেলে নিজেকে চমৎকার ভাবে ভাঙতে পারেন সেটা তিনি অনেকবারই প্রমান করেছেন। ‘ভুলজন্ম’’ নাটকে তার লুক, অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিনি প্রমান করলেন তার দরকার ভিন্নধর্মী গল্প, চরিত্র এবং দক্ষ নির্মাতাদের সাথে বেশি করে কাজ। ভালো নির্মাতা, ভালো কনটেন্ট এবং সংলাপ পেলে রোমান্টিক ঘরানার বাইরে যেয়েও মেহজাবীন যে দক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে অসাধারণ তা আমাদের মনে করিয়ে দেন তিনি বারবার।

টেলিভিশনের এই দুই জন জনপ্রিয় তারকাকে ভিন্নধর্মী চরিত্রে কাস্ট করে তাদের কাছ থেকে সুনিপুণ অভিনয় তুলে ধরার জন্য নির্মাতা ভিকি জাহেদ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। ‘জন্মদাগ’ ‘ইরিনা’ এবং ‘ভুল জন্ম’ এর পরে ভিকি-নিশো-মেহজাবীন এই ত্রয়ীর পরবর্তী কাজের জন্য অপেক্ষা করে থাকাটাই এখন একটু কষ্টের হবে। আশাকরি তারা নিজেদের সেরাটা নিয়েই হাজির হবেন সামনে।

নিশো এবং মেহজাবীন ছাড়া লুৎফর রহমান জর্জ তার চরিত্রের প্রতিও জাস্টিস করেছেন একথা বলতেই হয়। চরিত্র ছোট হলেও নাটকে তার ছাপ তিনি রেখেছেন। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা, মনুষ্যত্ব এবং বিবেকের অধঃপতন সহ আরো কিছু চিরন্তন সত্য নতুন করে তুলে ধরেছেন ভিকি জাহেদ সুনিপুণ ভাবে।

ভালো-মন্দ মিলিয়েই সমাজ একথা যেমন নাটকটিতে উঠে এসেছে তেমনি প্রচলিত ধারার বাইরে যেয়ে কোন কিছু মেনে নেয়াটা এখনো আমাদের জন্য কষ্টকর সেটাও দেখানো হয়েছে। তবে সেই মান্ধাতা আমলের কিছু প্রথা ভাঙ্গার জন্য এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকেই সেই বার্তা ও দেয়া হয়েছে।

আরটিভির প্রযোজনায় ‘ভুল জন্ম’র গল্প রচনা এবং পরিচালনা দুটো কাজই সফলতার সাথে সামলেছেন দক্ষ নির্মাতা ভিকি জাহেদ। নির্মাতা হিসেবে ভিকি জাহেদ আগেই জানান দিয়েছিলেন যে তিনি স্রোতের বিপরীতে হাটতেই পছন্দ করেন। তার পরিচালিত দি লাইফ অফ জলিল, রেহনুমা, বাঘবন্দি, নির্বাসন, এনাদার লাভ স্টোরি, মায়া, জন্মদাগ, ইরিনা নাটকগুলো দেখলেই সেটা বোঝা যায়।

ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় এই সময়ে যারা সংখ্যায় কম হলেও নিয়মিত ভাবে কাজ করছেন যেমন সাফায়েত মনসুর রানা, আশফাক নিপুনের মতো করে এই জেনারেশনের মধ্যে ভিকি জাহেদ বেশ সম্ভাবনা এবং আস্থার জায়গা তৈরী করতে পেরেছেন অত্যন্ত সফলভাবে। তার প্রতিটা নাটকেই কিছু মেসেজ দেবার একটা চেস্টা থাকে যেটা নান্দনিকভাবেই তুলে ধরেন তিনি।

ক্যামেরায় জাহিদ হোসেন অসাধারণ। মাহমুদ হায়াত অর্পনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভালো লেগেছে। অর্নব হাসনাতের সাউন্ড ডিজাইন ভালো। এছাড়াও কালার এবং এডিটিং এর দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। রাশেদ আল রশীদের মেকআপ বাস্তবসম্মত মনে হয়েছে। ভিকি জাহেদ সাধারণত নিজের এই টিমের সাথেই তার কাজগুলো করে থাকেন। হয়তো বোঝাপড়া বা আন্ডারষ্ট্যান্ডিং এর জায়গায় সবাই সবাইকে বুঝতে পারে বলেই প্রতিটা কাজই সফলতা পায়। পুরো টিমের জন্যই অভিনন্দন এবং শুভকামনা।

গল্পের শেষটা আমাদের ভাবায় তবে ভিকি জাহেদের আগের কাজগুলোতে এন্ডিং যেভাবে চমকে দিয়েছিলো এখানে সেটি হয়না তবে প্রায় একঘন্টার এই ফিকশন বোর করেনা। সমাজের দুই স্তর থেকে উঠে আসা দুইজন মানুষের ভিন্ন গল্প এবং জীবন যুদ্ধের গল্প হলেও তাদের কাছে আসা, আস্থা এবং অনুভূতির একটা সম্পর্ক স্থাপন চোখ এবং মনকে শান্তি দেয়।

কিছু সংলাপ মন কাড়লেও আরো একটু শক্তিশালী হলে হয়তো আরো ভালো হতো বলে মনে হয়। কয়েকটা বিষয় নিয়ে আরো কাজ করা যেতো হয়তো তবে ওভারঅল ‘ভুল জন্ম’ অনেক নাটকের ভীড়ে ভালো নাটক খোজা দর্শকদের জন্য মাস্ট ওয়াচ।

Ad