বিদায় বাহাদুর ওয়াসিম

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : বলা হয়ে থাকে যে, রূপালি পর্দায় নায়ক ওয়াসিম যখন ঘোড়া চালিয়ে আসতেন তখন প্রেক্ষাগৃহ দর্শকদের করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠতো। কেউ কেউ আবার শীষ বাজাতো। তার নাম দিয়েই ছিল তখন উল্লাসে ভরে যেতো সিনেমাহল গুলো।

মেজবাহ উদ্দীন আহমেদ নামের মানুষটি বাংলা চলচ্চিত্রে এসে হয়ে যান ওয়াসিম। পরবর্তীতে তার ভক্তরা সেই ওয়াসিম নামের সাথে যোগ করেন বাহাদুর। তিনি বনে যান বাহাদুর ওয়াসিম। চলচ্চিত্রের সেই সুপারষ্টার বাহাদুর ওয়াসিম আজ চলে গেলেন দুনিয়ার সব মায়া কাটিয়ে।

১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ চাঁদপুর জেলার আমিরাবাদে জন্মগ্রহণ করেন ওয়াসিম। পাকিস্তান আমলে কলেজের ছাত্র কালীন সময়েই তিনি বডি বিল্ডার হিসেবে নাম করেছিলেন। পরবর্তীতে বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় বডি বিল্ডিং প্রতিযোগিতায় নাম লেখান। এবং ১৯৬৪ সালে তিনি বডি বিল্ডিংয়ের জন্য মি. ইস্ট পাকিস্তান খেতাব অর্জন করেছিলেন। ওয়াসিম ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। পরবর্তীতে একটা সময় না চাইলেও নাম লেখান চলচ্চিত্রে এবং এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন এমনটাই হয়েছিলো ওয়াসিমের সাথে।

স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এস এম শফীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। পরিচালক শফী এই সুদর্শন যুবককে দেখেই অভিনয়ের অফার দিলেও তখন ওয়াসিমের অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ বা ইচ্ছে ছিলো না। কিন্ত শফীর আগ্রহেই ১৯৭২ সালে তার পরিচালিত ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ চলচ্চিত্রের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন ওয়াসিম। এই সিনেমায় ছোট একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেন তিনি পরিচালকের জোরাজুরিতে।

দুই বছর পরে ১৯৭৪ সালে আরেক প্রখ্যাত চিত্রনির্মাতা মোহসিন পরিচালিত ‘রাতের পর দিন’ চলচ্চিত্রে প্রথম নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ তার। চলচ্চিত্রটির অসামান্য সাফল্যে রাতারাতি তারকা বনে যান তিনি। তবে ১৯৭৬ সালে মুক্তি পাওয়া ওয়াসিম অভিনীত ও এস এম শফী পরিচালিত ‘দি রেইন’ তাকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। সময়ের তুলনায় সাহসী এবং পুরোপুরি ভিন্নধর্মী গল্পের সিনেমা ‘দি রেইন’ সেই সময়ে সারা বিশ্বের ৪৬টি দেশে মুক্তি পেয়েছিলো।

সিনেমাটি বাম্পার হিট হয় আর ওয়াসিমকে অভিনেতা হিসেবে পৌঁছে দেয় অনন্য উচ্চতায়। সুপারষ্টার খেতাব যোগ হয়ে যায় তার নামের সাথে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকার চলচ্চিত্রে ওয়াসিম ছিলেন শীর্ষ নায়কদের একজন। সেখানে সময়ের সবচেয়ে সাহসী নায়কও বলা হতো তাকে।

সব ঘরানার সিনেমায় অভিনয় করলেও মূলত ফোক ফ্যান্টাসি আর অ্যাকশন ধারার সিনেমায় তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সেই সময় পোষাকী সিনেমার প্রথম পছন্দ ছিলো ওয়াসিম। ওয়াসিম ১৫০ এর মতো সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন। হাতেগোনা অল্প কিছু সিনেমা ছাড়া প্রতিটি সিনেমাই হিট, সুপারহিট ব্যবসা করেছিলো।

দি রেইন, রাজ দুলারী, চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা, কে আসল কে নকল, বাহাদুর, দোস্ত দুশমন, ডাকু মনসুর, বানজারান, জিঘাংসা, মানসী, মিস লোলিতা, দুই রাজকুমার, সওদাগর, নরম গরম, ইমান, রাতের পর দিন, লাল মেম সাহেব, বেদ্বীন, জীবন সাথী, আসামি হাজির, রাজমহল, বিনি সুতার মালা, লুটেরা, রাজনন্দিনী সহ অসংখ্য ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি।

দর্শকনন্দিত এই অভিনেতার নামেই সত্তর এবং আশি দশকে সিনেমা হলে উপচে পড়ত দর্শক। ওই সময়ের প্রায় সব নায়িকার সাথে জুটি বেধে কাজ করলেও অলিভিয়া, অঞ্জু ঘোষ ও শাবানার সাথে ওয়াসিমের জুটি অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিলো। রোজিনার সাথেও বেশকিছু ব্যবসাসফল সিনেমা উপহার দিয়েছিলেন তিনি। নায়ক রাজ রাজ্জাক, জসিম, ফারুকের সাথেও অনেক সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি সমান গুরুত্ব নিয়েই।

এই বৃষ্টিভেজা রাতে চলে যেও না, বনমালী তুমি পর জনমে হইয়ো রাধা, আমি তোমারই প্রেম ভিখারী, চুমকি চলেছে একা পথে, এই মন তোমাকে দিলাম, পরদেশী মেঘ রে কোথাও যাসনা, ওরে মন চোরা, মনটা যদি খোলা যেতো, আয় আয় সোহাগী কাছে আয় সহ অসংখ্যা কালজয়ী গানের মধ্য দিয়েও তিনি মন জয় করেছিলেন সবার।

নায়ক থাকাকালীনই একটা সময় ওয়াসিম চলচ্চিত্র প্রযোজনায়ও নাম লিখিয়েছিলেন। তার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ডব্লিউ আর প্রোডাকশন। বেশকটি সিনেমা নির্মান হয়েছিলো তার প্রোডাকশন হাউজ থেকে। নব্বই দশক থেকে অনিয়মিত হয়ে পড়েন তিনি। শূন্য দশক আসতে আসতে এককথায় পুরোপুরি অবসরে চলে যান সোনালী যুগের এই সুপারষ্টার নায়ক।

খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা সন্তান হারানোর শোকই হয়তো তাকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো। অবসর নেবার পরে তিনি এফডিসিতে যান নি, যোগ দেন নি কোনো টিভি প্রোগ্রাম বা অনুষ্ঠানে। এককথায় লোকচক্ষুর অন্তরালেই কাটিয়েছেন দীর্ঘ একটা সময়।

দীর্ঘদিন ধরেই নানা রকম শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন ওয়াসিম। কিডনি সমস্যাই তাকে দূর্বল করে দিয়েছিলো। অবশেষে সব মায়া কাটিয়ে আজ তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। ওয়াসিম হয়তো বিদায় নিয়েছেন কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালী দিনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে তিনি রয়ে যাবেন অনন্তকাল তার ভক্ত এবং সিনেমাপ্রেমীদের অন্তরে।

সুত্র- উইকিপিডিয়া, ইত্তেফাক, একুশে টেলিভিশন অনলাইন

Ad