ভবিষ্যতে নিজের একটা গানের স্কুল করবো : তৃষা চ্যাটার্জী

ছেলেবেলা থেকেই প্লেব্যাক শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন পুষে বড় হয়েছেন তিনি। গানের জন্য ১৭ বছর বয়সেই পরিবার’কে ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল কলকাতা। গানের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি মিউজিকের উপর গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করার কারণেই গানকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া।

‘শুধু তুই, শুধু তুই/আর চাইছি না কিছুই’ গানের মাধ্যমে জনপ্রিয় প্লেব্যাক শিল্পীদের নামের তালিকায় নাম লিখেছেন তিনি। দু’বাংলার জনপ্রিয় এই প্লেব্যাক শিল্পী হলেন তৃষা চ্যাটার্জি। গানের জগতে প্রবেশ, ভালোলাগা, মন্দলাগা ও বর্তমান ব্যস্ততাসহ নানান বিষয়ে কথা বলেছেন অরণ্য সৌরভ।

করোনা মহামারীতে কি ভাবে সময় কাটছে?

তৃষা চ্যাটার্জী : পরিবারকে সময় দিতে পারছি বলে গতবছর প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগত। এছাড়া বাড়িতে সকলে এক সঙ্গে থাকার আনন্দটা ছিল অন্যরকম। প্রথম ভালো লাগলেও সময়ের সাথেসাথে পরিবর্তন হয়েছে। এ বছরটি ছিল আতঙ্কের। সেজন্য কাজকর্ম সবকিছু ভুলে পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও দেশের সবাই যেন ভালো থাকেন সেই প্রার্থনাই করেছি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আতঙ্কে থাকতাম, এই যেন কারো মৃত্যুর সংবাদ শুনবো।

বর্তমান সময়ের ব্যস্ততা সম্পর্কে কিছু বলুন?

তৃষা চ্যাটার্জী : বর্তমানে ব্যস্ততা বলতে তেমন কোনো ব্যস্ততা নেই। মাঝখানে কিছুটা ব্যস্ত ছিলাম। লকডাউনের কারণে আবার ব্যস্ততা কেটে গেল। লকডাউনের কারণে বাহিরে বের হওয়া নিষেধ, সেজন্য তেমন কোনো কাজও করতে পারছি না। মাঝখানে কলকাতায় কয়েকটা কাজ করেছি। বাসায় হোম স্টুডিও থাকায় আপাতত এখন বাড়িতে কাজ করার চেষ্টা করছি।

আপনি তো মূলত প্লেব্যাক শিল্পী। আপনি কি মনে করেন, গান আর প্লেব্যাকের মধ্যে পার্থক্য আছে?

তৃষা চ্যাটার্জী : গান আর প্লেব্যাক দুটো আলাদা ব্যাপার। আমার মতে, অনেক কষ্ট, পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে ফল প্রস‚তি হলো গান। এটি মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। কারণ গান করতে একটি হৃদম লাগে। কোন স্থানে কোন সুর বা কোথায় কেমন হবে এসব বুঝতে হয়। অন্যদিকে প্লেব্যাক কাজটি আরো কঠিন। কারণ চার দেয়ালের মাঝে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে হিরোয়িন, তার আবেগসহ সবকিছুকে নিজের করে গড়ে নিয়ে গাইতে হয়। তখন নিজের আবেগ বলতে কিছুই থাকে না। এটাই হচ্ছে ম‚লত পার্থক্য।

নিজের সবচেয়ে পছন্দের গান কোনটি?

তৃষা চ্যাটার্জী : নিজের গাওয়া সব গানই পছন্দের। তবে এর মধ্যে ‘শুধু তুই’ ও হইচই সিনেমার একটি গান খুব পছন্দের। কারণ ‘শুধু তুই’র জন্যই আমি সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেছি।

গানের জগতে আপনার অনুপ্রেরণা কে?

তৃষা চ্যাটার্জী: গানের জগতে আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা অরিজিৎ সিং। কারণ অরিজিৎ সিং একটি রিয়্যালিটি শো’তে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। অন্যদিকে আমিও সারে গামা পা’তে চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। এছাড়া তিনি যেখান থেকে উঠে এসেছেন আমিও সেখান থেকে এসেছি। আমি সবসময় অরিজিৎ সিং কে লক্ষ্য করতাম। তাকে দেখেই গানের জগতে আরো ভিড়েছি। তার মতো পরিশ্রম করতে পারলে আমিও একদিন নামকরা তৃষা হতে পারবো।

গানের পাশাপাশি আর কী করতে পছন্দ করেন?

তৃষা চ্যাটার্জী : মূলত গান ছাড়া আর তেমন কিছুই করা হয় না। সারাদিন প্র্যাকটিস করেই দিন কেটে যায়। যখন একটু সময় পাই তখনি নেট দেখি। এছাড়া ওয়েব সিরিজগুলো খুব ভালোলাগে আমার।

টিভি, মঞ্চ আর প্লেব্যাক কোন মাধ্যমে গান গাইতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

তৃষা চ্যাটার্জী : টিভি, মঞ্চ ও প্লেব্যাক তিনটিই আমার পছন্দের। মঞ্চে আমার গান শোনতে আসা মানুষদের দেখলে ভালো লাগে। মনে মনে ভাবি, এতো মানুষ আমাকে ভালোবাসে! প্লেব্যাক তো আমি নিজেই। আর টিভি ভালোলাগার কারণ আমি সেখান থেকে উঠে এসেছি।

গানের জগতের বর্তমান সময়ের অবস্থা কী? এই সময়ের গানগুলোর কোন দিকটি পরিবর্তিত হতে দেখতে চান?

তৃষা চ্যাটার্জী : এখনকার দিনে গানের একটি ট্রেড খুব তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হচ্ছে। আগে যেমন একই ট্রেডকে ফলো করে ১০ বছর ধরে গান চলতো এখন আর সেরকম ট্রেড দেখা যায় না। এখন খুব তাড়াতাড়ি ট্রেড বদলাচ্ছে।

আপনার নতুন গানের খবর বলুন?

তৃষা চ্যাটার্জী : ‘ওরে প্রিয়ারে’ নামে সম্প্রীতি একটি নতুন গান রিলিজ হয়েছে। আরো বেশ কিছু গানের কাজ চলছে। খুব তাড়াতাড়ি সেগুলোও রিলিজ হবে আশা রাখি। আরটিভি’র ফোক স্টুডিওতে একটি প্রজেক্টে ৬টি ফোক গান আছে। এটাও খুব তাড়াতাড়ি রিলিজ হবে। আরো অনেক গান আছে লকডাউনের উপরে নির্ভর করছে কবে রিলিজ হবে।

অনেক মাধ্যম থাকলেও গানকে বেছে নেওয়ার পেছনের গল্প কী?

তৃষা চ্যাটার্জী : গানের প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি মিউজিক নিয়ে পড়াশোনা করার কারণেই গানকে বেছে নেওয়া। আমি বাংলা গানের উপর গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার্স শেষ করেছি।

গানের জগতে পা রাখলেন কিভাবে?

তৃষা চ্যাটার্জী : গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এ জগতে আসা। গানের জন্যই পরিবার ছেড়ে ১৭ বছর বয়সে কলকাতা পাড়ি জমাই। পরে কলেজ ও ইউনিভার্সিটি শেষ করি। তারপর বরাবর ইচ্ছা ছিল প্লেব্যাক শিল্পী হবো। ছোটকাল থেকে স্বপ্ন পুষে বড় হয়েছি। অতঃপর একদিন সারে গামা পা’তে অংশগ্রহণ। এভাবেই ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে চলা।

গানকে কেন্দ্র করে আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

তৃষা চ্যাটার্জী : ভবিষ্যতে নিজের একটা গানের স্কুল করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমি নিজে যে কষ্ট করে গান শিখেছি অন্যদের যেন এমন কষ্ট করতে না হয়। যাতে সহজে শিখতে পারে।

অনেকেই বলেন, এই প্রজন্মের শিল্পীর মধ্যে সময়জ্ঞান কিংবা পেশাদারিত্ব মনোভাব নেই। এই প্রজন্মের শিল্পী হিসেবে আপনার মন্তব্য কী?

তৃষা চ্যাটার্জী : না, এই প্রজন্ম বলতে নয় প্রত্যেক প্রজন্মের বেলায় ঠিক। প্রফেশনাল হিসেবে যারা কাজ করছে তারাই কাজ পেয়ে থাকে। আজ আমি ইন্টারভিউ দিতে পারছি কারণ আমি সেখানে পৌঁছতে পেরেছি বলে। যদি পৌঁছাতে না পারতাম তাহলে কিন্তু আমাকে বলতেন না। যারা কাজ করছে তারা সবাই প্রফেশনাল। যারা এই জিনিসগুলো মেনে চলছে তারাই এগিয়ে যাচ্ছে। যারা মানতে পারছে না তারাই পিছিয়ে পরছে।

আপনার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট কী?

তৃষা চ্যাটার্জী : টার্নিং পয়েন্ট বলতে ‘শুধু তুই’ শিরোনামের গানটি।

যদি সুযোগ থাকে, জীবনে কি হতে চাইবেন?

তৃষা চ্যাটার্জী : ভবিষ্যতে যদি সুযোগ হয়ে উঠে তাহলে মিউজিক ডিরেক্টর হওয়া ইচ্ছা আছে।

আপনার গান অভিনেত্রীদের ঠোঁটে দেখতে পেয়ে, কেমন লাগে? অনুভতি কেমন?

তৃষা চ্যাটার্জী : খুবই ভালোলাগে। কারণ ১৭ বছর বয়সে যে স্বপ্নটা নিয়ে নিজের শহর, বাবা-মা ও পরিবার ছেড়েছি; সেই স্বপ্ন ১০ বছরে মধ্যে পূরণ করতে পেরেছি। আনন্দের পাশাপাশি অনেকটা দায়িত্ব বেড়ে যায় যে, আমাকে আরো কাজ করতে হবে। অভিনেত্রীর সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে।

নিজের ভালো এবং মন্দ দিক বলতে চাইলে, কী বলবেন?

তৃষা চ্যাটার্জী : প্রথমে আমি মন্দ দিকটা বলবো, ‘আমি মোডি’। তবে মানুষ হিসাবে খুব হাসি-খুশি। বাহির থেকে দেখে লোকে আমাকে যেমনটা ভাবে কিন্তু আমি ভিন্নরকম। বিশেষ করে আমাকে বোঝা খুব কঠিন। মাঝে মাঝে আমার নিজেকে নিজে চিনতেই কষ্ট হয়। কখন কি ভালো লাগে আর কি ভালো লাগে না আমি ভেবে পাই না। খারাপ দিক বলতে আমি মাঝে মাঝে মানুষের সাথে বাজে ব্যবহার করি।

‘আমি নেতা হবো’ সিনেমার ‘লাল লিপস্টিক’ এবং ‘সুপার হিরো’ সিনেমার ‘তোমাকে আপন করে’ শিরোনামের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন; এপার বাংলার গানের সাথে নিজেকে কিভাবে তুলনা করবেন?

তৃষা চ্যাটার্জী : আমি খুব লাকি যে, দুই দেশেই কাজ করতে পারছি। ‘লাল লিপস্টিক’ গানটির প্রতি মানুষ যে ভালোবাসা দেখিয়েছে কৃতজ্ঞতার ভাষা আমার জানা নেই। আশা করি, আগামীদিন আরো অনেক গান গাইতে পারবো।

এপার বাংলা’কে কেমন চোখে দেখেন কিংবা এপার বাংলা এবং এপার বাংলার গান নিয়ে আপনার অব্যক্ত কথাটি কী?

তৃষা চ্যাটার্জী : বাংলাদেশটাকে আমার দ্বিতীয় হোম মনে হয়। বাংলাদেশে থাকলে মনে হয় না যে, আমি বাহিরে আছি। এদেশের মানুষের এতো আন্তরিকতা, খুব সহজে সবাইকে আপন করে নেওয়াটা আমাকে মুগ্ধ করে। সে দেশের মানুষের কাছ থেকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতাটা প্রত্যেকবার বাংলাদেশে গিয়েই শিখে আসি। তাদের সাথে দেখা হয় না ঠিকই কিন্তু কোথায় যেন বিশেষ এই স্মৃতি রয়ে যায়। আশা রাখি, এখনকার মতো এমন সুন্দর সম্পর্ক যেন দু’টি দেশের কখনো শেষ না হয়। এখনকার মতোই দু’টি দেশ যেন সব সময় মিলেমিশে কাজ করে যেতে পারে তেমনটাই প্রত্যাশা করি।

দুই দেশের সংস্কৃতিতে (বিশেষ করে সংগীত) আপনি কি পার্থক্য দেখতে পান?

তৃষা চ্যাটার্জী : দুই দেশের গানের মধ্যে খুঁব বেশি পার্থক্য দেখি না। কারণ আগের থেকে বর্তমানে বাংলাদেশের গান-বাজনা অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশেষ করে ‘নয়া দামান’ গানসহ বেশ কিছু গান হিট হয়েছে। এই গানটি ভীষণ ভালো লেগেছে বলে গানটা কাভারও করেছি।

বাংলাদেশের ভক্তদেরকে কি বলতে চান?

তৃষা চ্যাটার্জী : বাংলাদেশের ভক্তদের প্রথমে ধন্যবাদ জানাই। আমাকে ও আমার গানকে ভালোবাসার জন্য। আশা রাখব, এভাবেই আগামীদিনও যেন আমাকে ভালোবাসে। মহামারীর এই খারাপ পরিস্থিতি শেষ হলে আবার বাংলাদেশে আসবো।

করোনা মহামারী প্রফেশনাল ক্যারিয়ারে কোনো প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন?

তৃষা চ্যাটার্জী : হ্যাঁ। এ করোনাভাইরাস আমাদের উপর অনেক প্রভাব ফেলেছে। আমরা ঠিকমতো কাজ করতে পারিনি। কোথাও বের হতে না পারায় স্টুডিও, রেকর্ড, শো কিছুই করতে পারিনি।

Ad