করোনাকালে বহতা জীবন: মহামারি কালে বদ্ধ জীবনে মুক্ত চিন্তার জীবনালেখ্য

মাশরুর শাকিল : টেলিভিশনের শাইখ সিরাজকে আপনারা চেনেন। দারুণ জনপ্রিয় অসাধারণ সুন্দর ভাবে কৃষি কৃষক, গ্রামীণ জনপদের সমস্যা ও সম্ভাবনা  ৪০ বছর ধরে তুলে ধরছেন। মাটি ও মানুষের কথা বলে একজন টেলিভিশন কর্মী কতটা জনপ্রিয় হতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি।

৪০ বছর আগে আশির দশকে বাংলাদেশ যখন শিল্পায়নের পথে যাত্রা করেছিলো  তখন  দৃষ্টির আড়ালে থাকা গ্রামের দিকে টেলিভিশনের মাইক্রোফোন হাতে ছুটে গিয়েছিলেন শাইখ সিরাজ। দুরন্ত সেই ছুটে বেড়ানো এখনো বিরতিহীন। যে কৃষক আমাদের খাদ্যের সন্ধান দেয়, অর্থের যোগান দেয়, জীবনের নিশ্চয়তা দেয়, আমাদেরকে সেই সব মানুষদের গল্প, কথা, জ্ঞানের সন্ধান দিয়েছেন তিনি। যারা তথাকথিত শহুরে মানুষের আত্মম্ভরিতা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে অনেক দূরে ছিল । প্রান্তের মানুষরা তখন টেলিভিশন কি বস্তু জানত না।

আপাত বিচ্ছিন্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীন জনগোষ্ঠী মাঠের কৃষকদের টেলিভিশনের মাধ্যমে কেন্দ্রের সাথে সংযোগ স্থাপনের অসাধ্য কর্ম সাধন করেছেন সিরাজ।  দীর্ঘ সময় পরিশ্রমের মাধ্যমে সহজ ভাষায় দারুণ দক্ষতায়  সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন কৃষি, কৃষক, মাটি ও মানুষের কথা।

শাইখ সিরাজ আপনাদের চেনেন খাকি পোশাকের টেলিভিশনের পর্দার মানুষ হিসেবে। করোনাকাল তাকেও বন্দি করেছিল রাজধানীর চারদেয়ালের ফ্ল্যাটবাড়িতে। অনাহুত বদ্ধ জীবনে তিনি আবিস্কার করেন আরেক জীবন। মহামারিকালে ঘটে যাওয়া একেবারে ভিন্ন ঘটনাবলীকে তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মহাসড়কে রেখে লিখলেন বই ‘করোনাকালে বহতা জীবন।’ চার দেয়ালে বদ্ধ জীবনে মুক্ত চিন্তার আলেখ্য!

এক বছরের বেশি সময় আমরা ঘর বন্দি ছিলাম। আলো ফোটার আগে সপ্তাহের প্রায় প্রতিদিন যিনি রাজধানী থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যেতেন তিনিও বন্দী হলেন। হঠাৎ করে এমন এক জীবনে আটকে যাওয়া তার দীর্ঘ ৪০ বছরের বহমান জীবনের সাথে একেবারে বেমানান। রাজধানীর ফ্ল্যাটবাড়িতে একান্নবর্তী পরিবারে সবাই আছে। তবু কি যেনো নেই। কোথাও যেনো শুন্যতা।

মন সব সময় পড়ে থাকে কৃষি-কৃষক, মাটির কাছে লাইট ক্যামেরা অ্যাকশনে। শহুরে মানুষের গ্রামীন ভাষায় সংযোগ স্থাপন,  আটচালা ঘরে থাকা, মুক্ত ভোরে মাঠে যাওয়া, তপ্ত দুপুরে ঘেমে একাকার হওয়া, বিষন্ন বিকেলে উঠোনে বাজারে গল্পগুজবে মেতে থাকা মানুষরাই তো তার আরেক বৃহৎ পরিবারের সদস্য।।

করোনাবন্দী জীবনে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ানো মানুষটি নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার সুযোগ পেলেন। টেলিভিশনের শাইখ সিরাজ ফ্ল্যাট বন্দী জীবনে দিনলিপি ঢংয়ে লিখলেন নিজের অতীত বতর্মান ভবিষ্যতের চিন্তা, কর্ম, দর্শন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি  লিখেছেন ৩৬০ পৃষ্ঠার বই ‘করোনাকালে বহতা জীবন’য়ে।

আমরা সুযোগ পেলাম টেলিভিশনের খাকি পোশাক পোশাকে কপট অভিনয়ে কৃষকের কথা বলা প্রিয় মানুষটির ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক পরিসর নিয়ে তার ভাবনা চিন্তা দর্শন জানার বুঝার।

নিজের জীবন তো বটেই, তিন পুরুষের একান্নবর্তী পরিবার, খিলগাঁওয়ে বেড়ে ওঠা শিশু, খেলা দেখার ছলে মতিঝিলে স্টেডিয়াম দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর, নায়িকা দেখতে গিয়ে এফডিসির দারোয়ানকে বোকা বানানোর যুবক, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সাথে তরুণ জীবনে রেস্টুরেন্টের ক্যাশিয়ার, বাংলাদেশ টেলিভিশনে মাটি মানুষ তৈরীর সংগ্রাম, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব টিভি থেকে ছিটকে পড়ে প্রিয় বন্ধুর সাথে দেশের প্রথম ডিজিটাল টেলিভিশন চ্যানেল গড়ার দুরন্ত চ্যালেঞ্জ। হৃদয়ে মাটি ও মানুষকে রাজধানী থেকে গ্রাম সবখানে সমানভাবে জনপ্রিয় করে তোলার পরিশ্রম।

খাদ্যে, মৎসে, শাক সবজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ায় গণমাধ্যমকে সবেচয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার, চলতে চলতে নিজের জীবনের সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে অসংখ্য জীবন যুক্ত করে ফেলার গল্প। প্রতিদিন করোনার আপডেটের সাথে কিভাবে দেশে ও বিদেশে পরিস্থিতির পরিবর্তন। কি নেই শাইখ সিরাজের করোনাকালের বহতা জীবনে। টানা পাচমাসে ভোর ও বিকেলের সাথে লেখা বইটিতে পাঠক টেলিভিশনের শাইখ সিরাজকে একান্তভাবে নতুনরূপে আবিস্কার করার সুযোগ পাবেন। টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে কোনভাবেই সেই সুযোগ ছিলো না।

টেলিভিশন অনুষ্ঠানের মতোই বইয়েও প্রানবন্ত সাবলিল বোকা বাক্সের পর্দায় মত লেখনিতেও সহজ সরল প্রানবন্ততার সন্ধান পাওয়া যায় করোনাকালের বহতা জীবনে। পড়তে পড়তে পাঠক মগ্ন চিত্তে একাত্ম হবেন শাইখ সিরাজের জীবন, চিন্তা, দর্শনের সাথে যেভাবে ক্ষেতের আইল ধরে দর্শকরা দীর্ঘসময় মুগ্ধ হয়ে আছেন  হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে।

বইয়ের সার্থকতা মূল্যায়নে একটি অন্যতম মাপকাঠি হলো নামের সাথে তার কনটেন্টের সাযুজ্য, চিন্তার সামঞ্জস্য, লেখনির বহমানতা। এক্ষেত্রেও দারুণ সফল আমাদের প্রিয় মানুষটি।

বইয়ের নাম ‘করোনাকালে বহতা জীবন’। বিচ্ছিন্ন দ্বীপে হঠাৎ আটকে যাওয়া জীবনকে রবিনসন ক্রুসোর মত কিভাবে উদযাপন করতে হয় তার মন্ত্র পাওয়া যায় বইয়ে। জীবন যেমন হোক মহামারীকালীন হোক, সুস্থ সময়ে হোক, অস্থিরতায় হোক, স্থিরতায় হোক, জীবনের প্রচন্ড আঘাতে ক্ষতবিক্ষত সময়ে হোক, আনন্দে আবিল হওয়া সুখসময়ে হোক। সময় ঘড়ি থেমে থাকে না কারো জন্যই। সে যত বড় মানুষই হোক কিংবা বিচ্ছিন্ন বিপন্ন উদ্দেশ্যহীন পথের পাশে পড়ে থাকা অকিঞ্চিৎকর মানুষটিই হোক।

বাধ্য হয়ে চার দেয়ালে বন্দি দুরন্ত মানুষটি বিপন্ন বিপর্যস্ত আপাত বিরোধিতার মাঝে পারিবারিক জীবনে সুন্দর মুহূতর্, পেশাগত জীবনে নতুন বাস্তবতায় সৃষ্টিশীল উপায়ের সমাধান, একান্নবর্তী পরিবারের দীর্ঘ জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, চলার পথে অসংখ্য মানুষের একটি জীবনের যুক্ত হয়ে যাওয়া, নিজেকে কেন্দ্রে রেখে বৃহৎ বৃত্ত আঁকা ৪০ বছরের চেষ্টা সাধনা। পার করে আসা পুরো জীবনের এক জীবন্ত ছবি শাইখ সিরাজের করোনাকালের বহতা জীবন।

দিন লিপি দিনলিপি নয়! আপাতদৃষ্টিতে দিনলিপি মনে হলেও এটি আসলে প্রচলিত কোনো দিনলিপি নয়। ঘরে বসে একান্তে নিজের বর্তমান ও পেরিয়ে আসা সময়কে কগজে কলমে প্রকাশ করার চেষ্টা।  বর্তমানকে কেন্দ্র করে ফিরে দেখা অতীত, বেড়ে ওঠা, পূর্বপুরুষের ইতিহাস, পিতার সংগ্রমী জীবন এবং বর্তমানে তার বৈশয়িক আরামের জীবনে পিতৃ জীবনের প্রভাব এবং নিজের ভবিষ্যত বীক্ষা।

বহতা জীবন বলেই বইটি শুরু হয়েছে হুট করে ২৩ মার্চ ২০২০ তারিখে চ্যানেল আই সংবাদ কক্ষে। করোনা নিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সংবাদ সম্মেলনের ব্রিফিংয়ের তথ্য দিয়ে। ৩৬০ পৃষ্ঠার বইটি পাঠককে নিছক ডাইরি পড়ার একঘেয়েমিতায় ক্লান্ত করবে না। বইয়ে উল্লেখিত প্রতিটি ঘটনায় শাইখ সিরাজের মত পাঠকও একাত্ম হয়ে যেতে পারেন। কারণ ঘটনাগুলো চেনা, আমার আপনার সবার জীবন ছুঁয়ে যাওয়া।

হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে তিনি জীবন ক্ষেতের আইল ধরে হাটার সময় দর্শকদের যুক্ত করেছেন। বহতা জীবনের প্রতিটি লাইনে চেতন অবচেতনে পাঠক যুক্ত করেন।  বইযের পাঠক পাঠ ভ্রমণে উপলব্ধি করবেন নিজেকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনকে। টেলিভিশনের শাইখ সিরাজকে পূর্ণ অবয়বে প্রাপ্তির সুযোগ ‘করোনাকালে বহতা জীবন’। শাইখ সিরাজের কলম বহমান থাকুক। সুস্থ দেহে দীর্ঘায়ু হোন এই কামনা করছি।

Ad