তনয় বিশ্বাস, নবীন কিন্তু সম্ভাবনাময়

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতীকে নিয়ে নির্মাতা এন রাশেদ চৌধুরী নির্মিত ‘চন্দ্রাবতী কথা’ মুক্তি পেয়েছে গত শুক্রবার। সরকারি অনুদানের এই পিরিওডিক্যাল সিনেমা মুক্তির পরেই সুস্থধারার মৌলিক গল্পের বাংলা সিনেমার দর্শকদের কাছ থেকে প্রশংসা পাচ্ছে।

ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য এবং জীবনযাপনের গল্প, চিত্রায়ণ, সংলাপ, সিনেমাটোগ্রাফি এবং সিনেমায় মূল চরিত্রগুলোর অভিনয় প্রশংসিত হয়েছে সবার কাছেই। অনেক চরিত্রের মাঝে অশোক নামের এক পটচিত্র শিল্পীর ভূমিকায় আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন তরুন অভিনেতা তনয় বিশ্বাস।

প্রায় পাঁচ বছর আগে এই সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া তরুন অভিনেতা তার পরিশ্রম, ত্যাগ এবং অভিনয় দক্ষতার মধ্যে দিয়ে আলোচনায়। একটি ব্যাতিক্রমী গল্পে প্রায় ১৪০০ বছর আগের একটি চরিত্র সেলুলয়েডে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে উপস্থাপন একজন নবীনের জন্য কম চ্যালেঞ্জিং নয়।

তবে এই যুদ্ধে তনয় বেশ ভালোভাবেই জয়লাভ করেছেন তার ডেডিকেশন এবং নৈপূর্ণ্যতার উপর ভর করে। এই গুনী তরুন অভিনেতাকে নিয়ে এই বিশেষ ফিচার।

অভিনয়ে তনয়ের শুরুটা থিয়েটারে প্রাচ্যনাটের স্কুলিং থেকে। মঞ্চে কাজ করার কারনেই তার অভিনয়, সংলাপ ডেলিভারি বা এক্সপ্রেশন, ফিটনেস নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন রকম চেস্টা সবসময়ই ছিলো। এর মাঝে বেশকিছু টিভিসি করা হয়। সেই সময়ে তার কিছু কাজে তার উপস্থিতি দেখে প্রযোজনা সংস্থা ম্যানগ্রোভের অফিসে ডাক পান তিনি।

সাদা ধুতি পরিধান করে ময়মনসিংহের ভাষায় একটি ছোট স্ক্রিন টেস্ট দিয়ে আসার সময়ই তিনি জানতেন না এটি একটি সিনেমার জন্য লুক টেস্ট। আরো অবাক হন তিন/চার দিন পরে তাকে যখন জানানো হয় এটি সিনেমা তো বটেই তবে গল্পটা সেই ১৪০০ বছর আগের সময়কার এবং অন্য সব শিল্পীদের সাথে তার রিহার্সালে অংশ নিতে হবে। অফার আসার পরে রাজী হয়ে যান তনয়, তিনি জানতেন আগামী দুই বছর তিনি চুল দাড়ি কাটতে পারবেন না।

গল্পের কারনে হাওড় অঞ্চল এবং বিভিন্ন ঋতু পর্দায় যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য অনেক সময় ধরেই কাজটা করতে হবে। তবুও সবকিছু পাশে সরিয়ে অন্যসব অফার ফিরিয়ে এই কাজটি করতে রাজি হয়ে যান তনয়। তার সেই ত্যাগ বা পরিশ্রম যে পুরোপুরি সফল এটা বোঝা যায় সিনেমা মুক্তির পর। সহ-শিল্পী বা অন্য তারকাদের কাছ থেকে প্রশংসা তো তিনি পাচ্ছেনই তবে সাধারণ দর্শকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পাচ্ছেন এটাই তনয়ের কাছে অনেক বড় একটি প্রাপ্তি।

শ্যুটিংয়ের সময়ে পাতলা ধুতি পরিধান করে তীব্র শীতের কবলে যেমন পড়েছেন তেমনি গল্প এবং চিত্রনাট্যের চাহিদা অনুযায়ী পায়ের উপর দিয়ে সাপ চলে যাবার ঘটনাও ঘটেছে তনয়ের সাথে। এই ইউনিটের অন্য সবার মতো তনয়কেও ব্যতিক্রম অভিনয় ধারা, ময়মনসিংহের ভাষা আয়ত্ত্ব নিয়ে কাজ করে যেতে হয়েছে রিহার্সালে।

একজন পটুয়া যখন ছবি আঁকেন তখন সেটার সাথে মিল রেখে সেই ছবির গল্পটা গানের মাধ্যমেও তুলে ধরেন। এজন্য তনয়কে আলাদা ভাবে সেই সময়ের একজন পটুয়া চিত্রশিল্পীর জীবন যাপন ধারা এবং পটুয়া চিত্রশিল্পী হিসেবে ট্রেনিং নিতে হয়েছে যাতে করে পর্দায় সেটি বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরতে পারেন।

‘চন্দ্রাবতী কথা’য় অশোক চরিত্রে এই তরুন অভিনেতার সাফল্য নিয়ে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি আগে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পরিচালক এন, রাশেদ চৌধুরী সহ ইউনিটের প্রতিটা শিল্পী এবং কলাকুশলীদের প্রতি। কারন এটা দিনশেষে একটা টিমওয়ার্ক তাই পুরো টিমের ডেডিকেশনের জন্যই ‘চন্দ্রাবতী কথা’ আজ আলোচনা এবং প্রশংসায়। এবং এতো পুরানো সময়ের একটি গল্পকে দর্শকেরা গ্রহন করেছেন এটাও একটা প্রাপ্তি বলে অভিহিত করেছেন তিনি।

সামনের দিনেও ভালো এবং ব্যতিক্রমী কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তনয়। সাথে আরো একটি মজার অভিজ্ঞতাও শেয়ার করেছেন তনয় যে, সিনেমায় শ্যুটিং এর সময় তার ওজন ছিলো ৪৫-৫০ এর ভেতর। আর এখন ওজন হচ্ছে ৭০ এর আশেপাশে এই কারনে অনেকেই তাকে সামনাসামনি দেখেও চিনতে পারেনা প্রথমে।

থিয়েটার স্কুলে কোর্স করার পর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে মাছরাঙা টেলিভিশনের একটা মেগা সিরিয়ালের মাধ্যমে প্রথম অভিনয় করার সুযোগ পান তিনি। পরবর্তীতে মোবাইল অপারেটর সংস্থা রবি এবং বাংলালিংকে কাজ করেছেন। এছাড়াও কোকাকোলা, ওয়ালটন, উপায় সহ বেশকিছু ব্র‍্যান্ডের বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করা হয়েছে তনয়ের। প্রতিটা কাজেই তার দক্ষতার ঝলক দেখিয়েছেন এই উদয়ীমান তরুন।

বাংলা, হিন্দী, দক্ষিণি, হলিউড, কোরিয়ান, চাইনিজ, স্প্যানিশ সহ সব ভাষার সিনেমা দেখেন তনয়। অনেকের মধ্যেও জনি ডেপ, নাসিরউদ্দিন শাহ এবং বাংলাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা প্রয়াত হুমায়ুন ফরিদী তার কাছে আইডল। প্রিয় সিনেমার নাম জানতে চাইলে তনয় জানান- আসলে সেভাবে তো বলাটা টাফ কারন এতো এতো সিনেমা আছে পছন্দের তালিকায় যে এর মাঝে অল্প কয়টার নাম নেয়াটাই যুদ্ধের চেয়ে কম না। তবে দ্যা শশাঙ্ক রিডেম্পশন, গুপি গাইন বাঘা বাইন, মাটির ময়না, প্যারাসাইট এবং এভেঞ্জারস আমার প্রিয় তালিকায় থাকবে সবসময়।

তনয় দৃঢ়তার সাথেই বলেন, আমি আসলে শিখতে চাই। আমি সারাজীবন অভিনয় নিয়েই থাকতে চাই। সবসময়ই তাই এই শেখার ব্যাপারটা আমার মাঝে কাজ করে। কারন অভিনয়, সংলাপ ডেলিভারি, লুক এসব নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট না করলে তো শেখা যায়না পুরোপুরি। আমি যেকাজেই জড়িত হইনা ক্যানো আমি আমার জায়গা থেকে ১০০% দেবার চেস্টা করবো।

মিডিয়াতে নতুন যারা কাজ করতে আসছেন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বলা হলে তনয় বলেন- ‘আমি আসলে এই সম্পর্কে কিছু বলার মতো যোগ্য এখনো হইনি তবে একটা কথা বলতে চাই যে, যে যেই সেক্টরে কাজ করে তাকে সেই কাজটার প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। শেখার ইচ্ছা থাকা খুব দরকার। নিজে যদি নিজের কাজটায় বিশ্বাস রাখা যায়, তাহলে সাফল্য আসবেই।’

সামনে বেশকিছু ভিন্নধর্মী কাজে দেখা যাবে তনয়কে। অনেকগুলো প্রজেক্ট নিয়ে কথাবার্তা প্রায় ফাইনাল হলেও অফিসিয়াল কোনো ঘোষণা না আসা পর্যন্ত এখনই সেসব সম্পর্কে জানাতে চাচ্ছেন না তিনি। শুভ কামনা রইলো এই তরুন অভিনেতার জন্য। ব্যতিক্রমী গল্পে এবং বৈচিত্র‍্যময় চরিত্রে সামনের দিনে তনয় বিশ্বাস তার অভিনয় দক্ষতা এবং সুনিপুণ সহজাত এবং সাবলীল উপস্থিতি দিয়ে নিজেকে নিয়ে যাবেন একটি নিজস্ব এবং স্বকীয় জায়গায় এটাই কামনা।

Ad