২৭ বছরে বিশ্বরঙ

২৭ বছরে আজকে যে বিশ্বরঙ তার শুরুটা বলতে গেলে মর্মে রঙ লাগানোর মতোই। কালক্রমে সেই রঙ ছড়িয়েছে কর্মে। ভরিয়েছে সকল গুনগ্রাহির আবরণ এবং মননে। একদিন শখের বসেই রঙ লাগানোর যে খেলা শুরু করেছিলাম তা সময়ের ধারা বেয়ে কেমন করে যেন দেখতে দেখতেই পেরিয়ে এল দুই যুগেরও বেশী সময়।

দেশীয় আত্মপরিচয়ের মূল্যবোধ থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয় স্বপ্ন যাত্রা ১৯৯৪ সালে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার শান্তনা মার্কেটে ১০০ স্কয়ার ফুটের একটা দোকান নিয়ে। দোকানের নামকরন করা হয় রঙ রাতারাতি সাফল্য যে আসে তা কিন্তু নয়। কিন্তু ক্রমেই নামটা ছড়িয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে।

সময়ের চারুকলার শিক্ষক মরণ চাঁদ পাল স্যারের কাছ থেকে তার তৈরী সিরামিকের সামগ্রী নিয়ে এসে বিক্রি হলে দাম দিয়ে আবার নতুন সামগ্রী কিনে আনা হতো। এভাবেই চলতে থাকে এই সিরামিকের আর্ট পিস গুলো, সাথে বিয়ে বাড়ীর ষ্টেজ আল্পনার কাজ। ক্রমেই বাড়ে এর চাহিদা। দোকানে তখনো কাপড়ের প্রবেশ ঘটেনি। সেটা আসতে সময় নেয় আরও কিছু দিন।

যখন স্বপ্নরা পাখা মেলে

১৯৯৫ সালে শাড়ি স্থান পায় সিরামিকের আর্ট পিস গুলোর পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান পন্যের তালিকায়। ঈদের সময় অত কাপড় কেনা, তাতে কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় পুঁজি থাকতো না। তখন পরিচিত কাছের মানুষরাই যুগিয়েছেন পুঁজি। তাই দিয়ে ঈদের সময় বিক্রির জন্য কাপড় তোলা হতো রঙ এ। মজার ব্যাপার হলো পন্যের তালিকায় রঙ এর প্রাথমিক সাফল্য আসে পাঞ্জাবিতে।

এতদিন যেটা ছিলো আবেগ বা শখ, সেটাই নতুন এক বোধের তৈরি করে আমার মধ্যে। এতদিন যেটা ছিল আবেগ শখ সেটাই রূপনেয় দায়িত্ববোধে। কারণ ততদিনে সরাসরি শত শত মানুষ জড়িয়ে গেছে রঙ এর কর্মকান্ডের সঙ্গে, জড়িত হয়েছে শত শত তাঁতী পরিবার প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে। রঙের শিল্পবোধ আর রুচির বাস্তবায়নের প্রধান কারিগর এরাই।

আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা

২০১০ সালে জাতীয় যাদুঘরে প্রথম বারের মত আমাদের প্রাত্যাহিক জীবনে রঙের উপস্থিতি নিয়ে রঙধনু শীর্ষক এক যুগান্তকারী প্রদর্শনীর আয়োজন করি, যা সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে বোদ্ধা মহলেও ব্যাপক প্রশংসা অর্জন করে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেও সরে আসিনি কখনো, দেশীয় বুটিক শিল্পকে রক্ষায় সময়ের প্রয়োজনে রাজ পথেও আমরা ছিলাম সরব।

শিশুদের মেধাবিকাশের লক্ষ্যে আয়োজন করি মা দিবসে আমার রঙে আমার মা শীর্ষক এক ব্যাতিক্রমধর্মী প্রতিযোগীতা প্রদর্শনীর। শিশুদের আকাঁ প্রানবন্ত চিত্রকলাকে ফ্যাশনের উপাত্ত হিসেবে ব্যবহার করে দিয়েছি ভিন্ন মাত্রা। উপস্থাপন করেছি নতুন সব শিশু শিল্পীদের।

২০ বছর পূর্তীতে আর টিভির সাথে যৌথ আয়োজনে করি ‘টোয়েন্টি-টোয়েন্টি কালার্স’ নামক প্রতিযোগিতা। ছাড়াও প্রতি বছর আয়োজন করি শারদ সাজে বিশ্বরঙ এর দিদি সারাদেশের টিনএজারদের মধ্য থেকে প্রতিভাবানদের বাছাই করে উন্নত প্রশিক্ষনের মধ্য দিয়ে এদেশের মিডিয়াকে প্রতি বছরই উপহার দিচ্ছি একঝাঁক করে নতুন মুখ। যাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও কাজ করছে প্রতিনিয়ত।

দেশীয় ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক বাহক 

এদেশের অন্যতম ফ্যাশন ব্র্যান্ড বিশ্বরঙ ১৯৯৪ সাল থেকে ভিন্নধর্মী কাজের জন্যই ফ্যাশন সচেতনদের অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত। বিগত সময়ে বাংলাদেশের ফ্যাশন জগতে ফ্যাশন সচেতনদের জন্য অন্তঃপ্রান প্রচেষ্টার ফসল আমাদের নিরীক্ষামূলক কাজ। এ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য – শখের হাড়ি, মুখোশ, নকঁশী পাখা, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলার পটচিত্র, বাংলা পঞ্জিকা, ঐতিহ্যে বাংলা সিনেমা, পানাম নগর, কান্তজী মন্দিরের টেরাকোটা, রিক্সা মোটিফ সহ আল্পনার মত মহামূল্যবান মোটিফকে পোশাকের অলংকরন হিসেবে ব্যবহার করে দেশীয় ফ্যাশনকে ইতিহাস ঐতিহ্যের মিশেলে নিয়ে যেতে চেয়েছি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমৃদ্ধির শিখড়ে।

প্রদর্শন করেছি আমেরিকা, ভারত, মালয়েশিয়া, কানাডা’র মত ফ্যাশন সচেতনদের দেশে। আমরা উপহার দিয়েছি পোশাকে অতি উজ্জল রঙের অনুভবকে যা বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাষ্ট্রিকে আরো রাঙ্গিয়েছে অনুকরনীয় ভাবে। টাঙ্গাইলের মলিন তাতের শাড়ীকে আধুনিক ফ্যাশনের অনুষঙ্গ করতে নিরলস প্রচেষ্টার ফলাফল বর্তমানে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাষ্ট্রিতে বিদ্যমান। বিভিন্ন দিবসে পোষাকের বর্নিলতা আমাদের মাধ্যমেই শুরু হয়, যা আজ অভিন্ন এক রীতিতে সামগ্রিক ভাবে প্রচলিত।

বিশ্বময় ছড়াতে নতুন করে যাত্রা শুরু

উদ্যোক্তা হিসেবে আপাদমস্তক শিল্পসত্ত্বায় পরিপূর্ন হতে চেয়েছি বারংবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ১ম বিভাগে এম এফ সম্পন্ন করে শিল্পসত্ত্বাকে দেশ জাতির কল্যানে ব্যবহারের প্রচেষ্টায় আত্মমগ্ন করি অবিরাম। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই অস্থির সময়েও নিজস্ব শেকড়ের সন্ধান করতে গিয়েই ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে দেশীয় তাঁত কে প্রাধান্য দিয়েছি সবসময়।

দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্যের বিশ্বব্যাপী মূল্যায়নে বিশ্বরঙ এর পথচলা সুদীর্ঘ ২৭ বছরের। সকল সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে সৃষ্টির ব্যাকুলতায় ১৯৯৪ সালের ২০ ডিসেম্বর সময় রাঙানোর ব্রত নিয়ে নারায়ণগঞ্জে সূচনা হয়েছিল ফ্যাশন হাউজ রঙ এর। সময়ের ব্যাপ্তিতে সময় রাঙানোর ব্রত টা রূপ নেয় এ দেশের ফ্যাশন সচেতন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসায়।

বিংশ শতাব্দী অতিক্রম করে একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে সময় রাঙানোর ভাবনাটা ছড়াতে চায় বিশ্বময়। রঙ যেন মোর মর্মে লাগে রবি ঠাকুরের এই অনুভবকে বিশ্বময় ছড়াতেই ২০১৫ সালে নতুন নামে পথচলা শুরু করে বিশ্বরঙ।

স্থবির সময়েও অদম্য সাহসে চলমান

করোনা মহামারিতে বাংলাদেশ সহ সমস্ত পৃথিবী যখন স্থবির, মানুষ গৃহবন্দী, প্রকৃতির কাছে মানুষের সমস্ত জ্ঞান, বিজ্ঞান তখন অসহায়। সকল শিল্প কারখানা বন্ধ, জীবন জিবিকার টানাপোড়নে মানুষ দিশেহারা। কাছের দুরের কতশত মানুষের মৃত্যু সংবাদ প্রতিদিনের নিয়ম হয়ে দাড়িয়েছিলো, তবুও জীবন থেমে নেই, চলেছে গতিহীন গতিতে।

তখনো বাংলাদেশের অন্যতম ফ্যাশন ব্রান্ড বিশ্বরঙ এ দেশের তাঁতীদের পাশে দাঁড়িয়েছে নিভৃতে, তাঁতশিল্প রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে বিভিন্ন ভাবে। শুধুমাত্র তাঁতীদের রক্ষায় অনলাইন সেবা চালুরেখে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছে তাদের পন্য, যাতে তাদের দু’মুঠো আহার জোটে।

ভালোবাসার কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ আমরা

‘বিশ্বরঙ’ এর সৃষ্টিশীলতা সবসময়ই সুস্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র। আমরা আমাদের স্থানীয় কারিগর, তাঁতি, সূচীশিল্পী, কারুশিল্পীদের সাথে কাজ করি এবং বিস্ময়কর ভাবে প্রাণবন্ত সংগ্রহের পরিসীমা অতিক্রম করি ফ্যাশন প্রেমীদের অভিন্ন নিরবিচ্ছিন্ন চাহিদাকে। আমাদের নকশাগুলি আমাদের লোক সংস্কৃতির ঐতিহ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত যা ঐতিহাসিক ভাবে দক্ষতার উৎস হিসাবে একটি নির্ধারিত ভুমিকা পালন করে আসছে সুদীর্ঘ ২৭ বছর ধরে।

নতুন সব ভাবনার আয়োজনে পরিবারের শ্রদ্ধাভাজন ব্যাক্তিটির জন্য ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা জানাতে নিয়ে এসেছে বিশ্বরঙ এর সহযোগী ব্রান্ড ‘শ্রদ্ধা’ তেমনি দেশীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক চলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে টিনএজদের জন্য বাহারি নকশা বৈচিত্রময়তায় উপস্থাপন করেছে ‘ফেইসরঙ’ এবং বিশ্বরঙ মেনজ তেমনি শিশুদের জন্য রয়েছে ‘বিশ্বরঙ কিডস’

এই সুদীর্ঘ সময়ের পথচলায় ‘বিশ্বরঙ’ এর পাশে ছিলেন সাংবাদিক বন্ধুরা, বিভিন্ন মিডিয়া কর্মীরা, মিডিয়া তারকারা, অভিনেতা, অভিনেত্রী, মডেল সহ নানান শ্রেণির পেশার শুভানুধ্যায়ীরা। তাদের প্রতি অকৃত্রিম অশেষ কৃতজ্ঞতা। ‘বিশ্বরঙ’ পরিবার সবসময় কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে শুভানুধ্যায়ীদের। শুভেচ্ছা সবসময়ের।

Ad