সুমন সরকার – একজন ইঞ্জিনিয়ারের দেশসেরা সিনেমাটোগ্রাফার হবার গল্প

আফজালুর ফেরদৌস রুমন 

সম্প্রতি রিলিজ পাওয়া ‘দামাল’ যারাই প্রেক্ষাগৃহে দেখেছেন অথবা ইউটিউবে সিনেমাটির ট্রেলার বা গান উপভোগ করেছেন তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন এই সিনেমায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইউএসপি চিত্রগ্রাহক সুমন সরকারের মনোমুগ্ধকর চিত্রায়ণ। প্রথম সিনেমা ‘ন ডরাই’ দিয়েই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয়ী এই মেধাবী তরুন তার দক্ষতার ছাপ রেখেছেন দ্বিতীয় সিনেমাতেও। আজ ক্যামেরার পেছনের এই জাদুকরকে নিয়েই এই বিশেষ ফিচার।

একজন চিত্রগ্রাহক বা সিনেমাটোগ্রাফার তার ক্যামেরার মাধ্যমে একটি চলচ্চিত্রের গল্প এবং চিত্রনাট্য সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবেই উপস্থাপন করে থাকে যা দর্শকদের সেই গল্পের সাথে বেঁধে রাখতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ক্যামেরার ফ্রেমে লাইটিং, প্রপস, শিল্পীদের অবস্থান এবং তাদের সংলাপ বলার সময় কোন দিকে তাকাতে হবে সবকিছুই সুনিপুণ ভাবে ঠিকঠাক ক্যামেরা বন্দী করাও একজন সিনেমাটোগ্রাফারের কাজের মধ্যেই পড়ে। নির্মাতা ঠিক কিভাবে গল্পটি ক্যামেরায় ধারণ করতে চান সেটার দিকে লক্ষ্য রেখেই একজন সিনেমাটোগ্রাফারকে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। সেই হিসেবে জনপ্রিয় নির্মাতা রায়হান রাফির এই ড্রিম প্রজেক্ট ‘দামাল’ সুমন সরকারের নান্দনিক ম্যাজিকে আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে পুরোটা সময়। নির্মাতা রাফির ভিশন সিনেমাটোগ্রাফার সুমনের এক্সিকিউশনে নান্দনিক এক নির্মান হিসেবে প্রশংসা পাচ্ছে সকলের কাছ থেকেই।

‘ন ডরাই’তে সার্ফিং থাকলে সেটার চিত্রায়ণের সাথে ‘দামাল’ এর চিত্রায়ণে আকাশ পাতাল ফারাক আছে বলে একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন সুমন সরকার নিজেই। ফুটবল মাঠে ফুটবল খেলার মতো জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং সাবজেক্ট ঠিকঠাক ভাবে ক্যামেরায় ধারণ করাটা পুরো ‘দামাল’ টিমের জন্যই বিশাল একটি পরীক্ষা ছিলো। অভিনেতাদের পাঁচ ছয়মাসের ট্রেনিং দিয়ে যেভাবে ফুটবলার হিসেবে বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়েছে তেমনি নির্মাতা রায়হান রাফি বা সিনেমাটোগ্রাফার সুমন সরকারও নিজেদের চেষ্টা এবং চেনা ছক ভেঙে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সেই গৌরবের গল্প নিয়ে নতুন কিছু উপহার দেবার যে প্রয়াসের মধ্য দিয়ে গেছেন তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ ‘দামাল’। এককথায় গল্পে যেমন নতুনত্ব ছিলো দৃশ্যায়ণেও সেই নতুন এবং শক্তিশালী একটা ভাব হাজির ছিলো প্রতিটি ফ্রেমেই।

১৯৭০ সালের ঢাকা শহরের চিত্র যেভাবে এই সিনেমায় উঠে এসেছে তেমনি মফস্বলি গ্রাম হোক বা যুদ্ধের সময়কার মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প অথবা হানাদার বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের ক্যাম্প সবই ছিলো বিশ্বাসযোগ্য। পাশাপাশি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের যে কয়টা ম্যাচ দেখানো হলো সেগুলোও চমৎকার লেগেছে স্ক্রিনে। ফুটবলের মতো একটা গতিশীল খেলা ক্যামেরায় ধারণ করা চাট্টিখানি কথা নয় তা আমাদের সবার জানা। তবে সেই কঠিন কাজটিই অসাধারণ নৈপূন্যর সাথেই তুলে ধরেছেন সুমন। স্ট্রাইকার দুর্জয় তথা সিয়ামের গোল করার সেই অনবদ্য দৃশ্য হোক বা অধিনায়ক মুন্না তথা শরিফুল রাজের বাইসাইকেল শট হোক অথবা গোলকিপার সুমিতের ম্যাচ জেতানোর জন্য প্রতিপক্ষের গোল ঠেকিয়ে দেয়ার সিন, সুমন সরকারের ক্যামেরার জাদু আমাদের প্রেক্ষাগৃহের আসনে ধরে রেখেছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো করেই। এখানেই একজন সফল চিত্রগ্রাহক হিসেবে সুমন সরকার জিতে গেলেন। স্পোর্টস জনরার এই সিনেমার বিশাল ক্যানভাস হোক বা বিগ বাজেট একটা কথা প্রমান করেছে টেকনিক্যাল নানা সীমাবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে এই জায়গাটায় কাজ জানা দক্ষ কিছু মানুষ অবশ্যই আছে যারা সুযোগ-সুবিধা পেলে দেশেই মানসম্মত কাজ করে সারা বিশ্বকে চমকে দেবার ক্ষমতা রাখে।

অনেকেই জানেন না যে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করা এই ইঞ্জিনিয়ার মানুষটি এখন লাইট, ক্যামেরা এবং অ্যাকশন জগতের স্থায়ী বাসিন্দা। সাইন্স বিভাগের এই মেধাবী তরুন কোনো সায়েন্স ল্যাবের পরিবর্তে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আর্ট কালচারের রূপালী জগতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই ফিল্ম ক্লাব এবং ফটোগ্রাফিক নানা আয়োজনে যুক্ত হবার কারনে আস্তে আস্তে বিনোদন ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে একটা আগ্রহ তৈরী হয় তার মাঝে। পরবর্তীতে তিন বন্ধু মিলে ২০১৩ সালে মোবাইল অপারেটর কোম্পানি ‘রবি’র একটি শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যালে নিজেদের বানানো একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ফিকশন নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করেন।সেখানেই তাদের কাজ দেখে নন্দিত নির্মাতা অমিতাভ রেজা চৌধুরী সুমন সরকারকে ‘সারফেস’ নামক একটি ফিকশনে চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজের অফার দেন। সুমন সরকার নিজেই জানিয়েছেন এই ‘সারফেস’ তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। তবে কৌশিক শংকর দাসের সহকারী হিসেবে এই মিডিয়াতে কাজ শুরু করেছিলেন সুমন। পঙ্কজ পালিতকে নিজের শিক্ষক এবং আরেক জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত চিত্রগ্রাহক রাশেদ জামানকে মেন্টর হিসেবে মনে-প্রানে ধারন করেই এগিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান সুমন। তার মতে- এই মানুষগুলো আমাকে যে জ্ঞান এবং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে সেটাই আমাকে একজন দক্ষ সিনেমাটোগ্রাফার হওয়ার পথে নিয়ে গেছে। আসলেই কঠোর পরিশ্রম, ত্যাগ এবং ধৈর্য্য সুমন সরকারকে আজ নিয়ে এসেছে সফলতার কাতারে।

আমাদের বিনোদন ইন্ডাস্ট্রিতে এই সময়ের অন্যতম আলোচিত এবং দক্ষ চিত্রগ্রাহক হিসেবে সুমন সরকার নিজের সাফল্যের মুকুটে নতুন পালক যুক্ত করলেন বিগ স্কেলের ‘দামাল’ সিনেমার মাধ্যমে। নিজের কাজের প্রতি ডেডিকেশন এবং প্রতিনিয়ত ক্যামেরার মাধ্যমে একটা গল্প এবং চরিত্রগুলোকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে উপস্থাপন করার মধ্য দিয়ে সামনের দিনে একজন আইডিয়াল সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে সুমন সরকার নিজেকে নিয়ে যাবেন এক অন্য উচ্চতায় এই কামনা রইলো।

Ad