তিনি আমাদের সুপার রুনা

আফজালুর ফেরদৌস রুমন 

ক্যালেন্ডারের হিসাবে ৭০টি বসন্ত পার করা জীবন্ত কিংবদন্তি গায়িকা রুনা লায়লা নিজেই একটি নান্দনিক ইন্সটিটিউশন। ১৯৫২ সালের ১৭ নভেম্বর সিলেটে জন্ম নেয়া সেই ছোট্ট মেয়েটি মাত্র আড়াই বছর বয়সে বাবার চাকরি সুত্রে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাড়ি জমান পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রথমে মুলতানে পরিবার সহ বসবাস শুরু করলেও তার শৈশব কাটে পাকিস্তানের লাহোরে। সংগীতশিল্পী মায়ের কাছ থেকে সংগীতের প্রাথমিক শিক্ষা পাবার পরে করাচির সংগীতজ্ঞ আব্দুল কাদের পিয়ারাঙ্গ ও হাবীব উদ্দিন খানের কাছে তালিম নেন রুনা লায়লা। ছয় বছর বয়সে গান শুরু করেন তিনি। মাত্র সাড়ে ১১ বছর বয়সে পাকিস্তানের ‘জুগনু’ সিনেমার মাধ্যমে প্লেব্যাকের খাতায় নাম লেখান রুনা লায়লা। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। প্লেব্যাক শুরু করেন তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকগুলো সিনেমাতে।

দিল ধাড়কে ম্যায় তুমসে, আপ দিল কি আনজুমান ম্যায়, মেরা বাবু ছ্যাল ছাবিলা ম্যায়তো সহ একের পর এক সুপার ডুপার হিট গান উপহার দিয়ে ষাট দশকের শেষের দিকে
এবং সত্তর দশকের প্রথমার্ধ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় গায়িকা হিসেবে নিজেকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। বলা হয় ওই সময় লাহোর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে উপমহাদেশে আরেক কিংবদন্তি গায়িকা ম্যাডাম নূরজাহানকে পাল্লা দেবার মতো একজন শিল্পীই ছিলেন এবং তিনি আমাদের রুনা লায়লা। তবে সত্তর দশকের মাঝামাঝি পুরো পরিবার নিয়ে নিজ দেশ বাংলাদেশে ফেরত আসেন রুনা লায়লা। এবং বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সেই সময় থেকেই যে সোনালী যুগের শুরু হয়েছিলো তা এখনো বিদ্যমান। ১৯৭৪ সালের শুরুতে প্রয়াত সত্য সাহার সুরে ‘জীবন সাথী’ ছবিতে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক করেন রুনা লায়লা। ‘শিল্পী’ নামের একটি চলচ্চিত্রে মূল ভূমিকাতেও অভিনয় করেছেন এই গুণী মানুষটি।

আশির দশকে ভারতেও অভাবনীয় সাফল্যে পান গায়িকা রুনা লায়লা। বাপ্পি লাহিড়ীর সুরে পপ আ্যলবাম ’সুপার রুনা’ এতোটাই সাড়া ফেলে সেই সময়ে যে, আ্যলবামটি রিলিজের দিনেই সারাবিশ্বে এক লাখ কপি বিক্রি হয়। উপমহাদেশের খুব কম সঙ্গীতশিল্পীর জীবনে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এই আ্যলবামের জন্য গোল্ডেন ডিস্ক অ্যওয়ার্ডের মতো দুর্লভ সম্মান নিজের নামে করে নেন সুকন্ঠী গায়িকা রুনা লায়লা। নব্বই দশক পাকিস্তানি সুরকার নিসার বাজমির সুরে একদিনে ১০টি করে তিন দিনে ৩০টি গানে কণ্ঠ দিয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসেও নাম লেখান রুনা লায়লা। পাকিস্তানের পরে ভারতেও এক ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’ গান দিয়ে ব্যাপক পরিচিতি এবং সুনাম অর্জন করেছেন তিনি। বলিউডের সনু নিগম সহ আশি এবং নব্বই দশকের অনেক গায়ক-গায়িকাদের পছন্দের শিল্পীর তালিকায় রুনা লায়লার নামটি উচ্চারিত হয়ে আসছে আজো…

বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি, সিন্ধি, গুজরাটি, বেলুচি, পশতু, ফার্সি, আরবি, মালয়, নেপালি, জাপানি, স্পেনীয়, ফরাসি, ইতালীয় ভাষাসহ ১৮টি ভাষায় রুনা লায়লার গাওয়া গানগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে আসছি আমরা। তার গানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি বলে জানা গেছে। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে সেই সত্তর থেকে যে অভাবনীয় সাফল্যে ভরা এক পাঁচ দশকের দীর্ঘ যাত্রা চলছে রুনা লায়লার তা অবাক করার মতোই। গান গাইবার পাশাপাশি সুরকার হিসেবেও নিজের প্রতিভার জানান দিয়েছেন তিনি।

দীর্ঘ পাঁচ দশকে অসংখ্য কালজয়ী গান উপহার দিয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গায়িকা রুনা লায়লা। পাশাপাশি বাংলাদেশকে সাফল্যের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। লোকজ, পপ, রক, গজল, আধুনিক সহ প্রায় সব ধাঁচের গানই গেয়েছেন তিনি। তার মাধ্যমেই বাংলাদেশে স্টেজ শো বা লাইভ শো গুলোতে আধুনিক ভাবে গান উপস্থাপনের বিষয়টি আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা এবং ধারাবাহিকতা পেতে শুরু করে। শুধু গানই নয়, তরুণ প্রজন্মের কাছে ফ্যাশন আইকনেও পরিণত হয়েছেন তিনি। তাঁর সাজসজ্জা, পোশাক, গাওয়ার ভঙ্গি থেকে শুরু করে সবকিছুই তরুণ প্রজন্মের কাছে অনুসরণীয়। দেশে এবং বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার জয় করেছেন তিনি। তবে আসল পুরস্কার নিঃসন্দেহে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা তার ভক্তদের ভালোবাসা।

উপমহাদেশের সংগীত নিয়ে যখনই আলোচনা হবে তা ইতিহাস নিয়ে আজ থেকে বহু বছর পরেও যাচাই বাছাই হবে রুনা লায়লার নাম তখনো আকাশের উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলজ্বল করবে তা বলা যায় নিঃসন্দেহে। তিনি অমর হয়ে রইবেন তার অসাধারণ মন্ত্রমুগ্ধ করা গায়কী এবং মানবিক নানা দিকের জন্য। এই মহাগায়িকার জন্মদিনে রইলো অনেক অনেক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং দোয়া….

Ad