দর্শকদের আগ্রহ এবং নির্মাতাদের আস্থায় অভিনেতা খায়রুল বাসার

আফজালুর ফেরদৌস রুমন 

২০১১ সাল থেকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে নিজের অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে যে পথচলার শুরুটা তিনি করেছিলেন ২০২২ সালে এসে মাধ্যম বা ধারা বদল হলেও নাটক, সিনেমা বা ওটিটিতে সেই দক্ষতা, প্রতিভা এবং পরিশ্রমের জোরেই এই সময়ে আমাদের দেশের অন্যতম আলোচিত এবং প্রশংসিত অভিনেতা তিনি। বলছি বা লিখছি প্রতিভাবান অভিনেতা খায়রুল বাসারের কথা। বর্তমান প্রজন্মের এই জনপ্রিয় অভিনেতার জন্মদিন উপলক্ষে এই বিশেষ ফিচার।

একটি সংগঠনের কোনো এক আয়োজনে ২০১০ সালের দিকে প্রথমবার খায়রুল বাসার তার ক্যাম্পাসের সিনিয়র মীর লোকমানের মূকাভিনয় দেখার সুযোগ পান। তখন থেকেই প্রচন্ড মুগ্ধতা এবং ভালোলাগা কাজ করে এই মূকাভিনয়ের প্রতি। পরবর্তীতে ক্যাম্পাসের সেই সিনিয়র ভাইয়ের সাথে ভালো একটা সম্পর্ক তো হয়ই এমনকি নিজের অভিনয় গুরু হিসেবেও তাকে নিয়ে ২০১১ সালে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন’ নামে মূকাভিনয় সংগঠন নিয়ে দুজনে যাত্রা শুরু করেন। তখন থেকেই নিয়মিত অভিনয় চর্চা শুরু হয় তার।

তারপর দেশে ও দেশের বাইরেও মূকাভিনয় নিয়ে অবিরাম ছুটেছেন খায়রুল। ২০১১ থেকে ২০১৭ সালের এই সময়টাতে প্রায় ৪০০ শো করেছিলেন (স্ট্রিট শো এবং স্টেজ শো মিলিয়ে)৷ মূকাভিনয় দল নিয়ে দেশের বাইরেও গিয়েছেন তারা। সেখান থেকেও অভিনয়ের জন্য পুরস্কার এবং প্রশংসা পেয়েছেন। একটি সাক্ষাৎকারে খায়রুল বাসার জানিয়েছেন- ‘মূলত মঞ্চে উঠে প্রতি মুহূর্তে মূকাভিনয়ের ইলুশন তৈরি করে যাওয়ার চেষ্টা এবং দর্শকের মুগ্ধতা দেখেই আমার মনে হয়েছে, আমি এটাই করতে চাই। ধীরে ধীরে আমার বিশ্বাস হতে শুরু করলো যে, আমি অভিনেতা। তখনই অভিনয় করার প্রতি এক ধরনের টান অনুভব করেছি।’

২০১৭ সাল পর্যন্ত খায়রুল সক্রিয় ছিলেন মূকাভিনয়ে৷ পরবর্তীতে ভিজ্যুয়াল কাজে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় মূকাভিনয়ে সময় না দিতে পারাটা এখনো এক ধরনের কষ্টের অনুভূতি তার কাছে। টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির সাথে পরিচয়ের সুত্রটা প্রজন্ম টকিজের মাধ্যমে। এই প্ল্যাটফর্মে ১০টা শর্টফিল্ম বানানো হয়৷ যার একটাতে অভিনয় করেন খায়রুল বাসার। সালেহ সোবহান অনীমের পরিচালনায় সেই শর্টফিল্মের নাম ‘পুনরাবৃত্তি’।

তবে তাকে লাইমলাইটে আসার সুযোগটা করে দিয়েছিলেন সৈয়দ আহমেদ শাওকী। একটি বিজ্ঞাপনে কাজের সুত্রে পরিচয়। তবে খায়রুল বাসারের ভেতরের পটেনশিয়ালটি বুঝতে হয়তো সময় লাগেনি তার। তাই ভরসা করে এই কাজটিতে সুযোগ করে দেন। এবং খায়রুল বাসার নিরাশ করেননি তাকে। প্রথম কাজ হলেও অভিনয় প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছেন তিনি সুনিপুণ ভাবেই। এরপরের কাজ আলোচিত এবং জনপ্রিয় ফিকশন ‘কথা হবে তো?’ এই নাটকে আবারো অসাধারণ অভিনয় করে মোটামুটি আলোচনায় আসেন তিনি। অনম বিশ্বাসের পরিচালনায় ‘তোমার পাশে হাঁটতে দিও’ এবং ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’ নাটক দুটিও তাকে চলার পথে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে যায়।

ক্লোজআপের আয়োজনে ‘তোমার পাশে হাঁটতে দিও’ বা ‘একদিন বৃষ্টিতে বিকেলে’ নাটকগুলো যারা দেখেছেন, মূল চরিত্রে তার অভিনয়ের প্রশংসা করেননি এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। গল্প, নির্মান, অভিনয় নাটক দুটিকে ভীষণ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিলো। ব্যাপক প্রচারণার কারনে অল্প সময়েই পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন খায়রুল বাসার।

এখন পর্যন্ত চারটি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন খায়রুল বাসার। প্রথম চলচ্চিত্র ‘ক্যাম্পাস ক্লাইমেক্স’। পরিচালক ছিলেন জিত দে। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শ্যুটিং করা হয় এই সিনেমার। ক্যাম্পাস লাইফের নানা বৈচিত্র্য আমেজ উৎসব নানা সংকট এই গল্পে তুলে আনা হয়েছে। ছাত্র জীবনে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এই চলচ্চিত্র তৈরির সময় অভিনেতা হিসেবে কোন আপোষ করেননি তিনি। তবে ২০১৯ সালে অ্যান্থোলজি সিনেমা ‘ইতি, তোমারই ঢাকা’ দিয়েই আক্ষরিক অর্থে অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পান তিনি। এই সিনেমায় তানভীর আহসানের পরিচালনায় ‘আকাশের পোষা পাখিরা’ দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। গত বছর মুক্তিপ্রাপ্ত মাসুদ হাসান উজ্জ্বল পরিচালিত ‘ঊনপঞ্চাশ বাতাস’ সিনেমায় মূল ভূমিকায় শার্লিন ফারজানা এবং ইমতিয়াজ বর্ষণের পাশাপাশি পার্শ্ব চরিত্র হিসেবে খায়রুল বাসার নজরে পড়েন সবার। ভিন্নধর্মী কনটেন্ট নিয়ে নির্মিত এই সিনেমা প্রশংসা কুড়ায় সিনেমাবোদ্ধাদের। সাজ্জাদ খানের পরিচালনায় ‘সাহস’ নামের ভিন্নধর্মী একটি চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে তাকে এক্সটেন্ডেড ক্যামিও হিসেবে। ‘পুনরাবৃত্তি’, ‘পোস্টার’ আর ‘মাকড়শা’ নামে তিনটি শর্টফিল্মেও অভিনয় করেন তিনি।

তবে ২০২১ সালে এসে বদলে যাওয়া বিনোদনের মাধ্যম ওটিটি আমাদের দেশে জনপ্রিয় এবং আলোচিত হয়ে উঠলে নির্মাতারা এই মাধ্যমে দেশের জনপ্রিয় এবং আলোচিত তারকাদের পাশাপাশি নতুন এবং প্রতিভাবান শিল্পী কলাকুশলীদের নিয়ে ব্যতিক্রমী গল্পে কাজ শুরু করেন। এই সমীকরনে যে কয়জন নতুন প্রতিভাবান অভিনেতা আমরা পেয়েছি তাদের মধ্যে অন্যতম আলোচিত নাম খায়রুল বাসার। ‘একাত্তর’, ‘চরের মাষ্টার’, ‘বিলাপ’, ‘ডার্ক সাইড অব ঢাকা’ একের পর এক ভিন্নধর্মী গল্পে ব্যতিক্রমী চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন তিনি।

যেকোনো চরিত্রে মানিয়ে যাবার গুন তাকে আগামীর অন্যতম সেরা দক্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। ভারতীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া আমাদের দেশীয় ওয়েব সিরিজ ‘মহানগর’- এ মোশাররফ করিম, জাকিয়া বারী মম, শ্যামল মাওলা, মোস্তাফিজুর নূর ইমরানের পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। আশফাক নিপুনের পরিচালনায় এই সিরিজটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে ভারতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা পেয়েছে। প্রতিটি চরিত্রে সকলেই দিয়েছেন তাদের সবটুকু। ফলও মিলেছে হাতেনাতে, প্রত্যেকেই ভক্তদের প্রশংসা পাচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে দেশীয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে রিলিজ পাওয়া মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘নেটওয়ার্কের বাইরে’ ওয়েবফিল্মে অন্য সব চরিত্রের মতো তার চরিত্রটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। রীতিমতো সাড়া ফেলা এই ওয়েবফিল্ম তারকা খ্যাতি এনে দেয় মূল ভূমিকায় অভিনয় করা সবাইকে। খায়রুল বাসারকে এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নাই। ভিকি জাহেদের ব্যাপক জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পূর্ণজন্ম-২ এবং পূর্ণজন্ম-৩ এর পাশাপাশি এই ইউনিভার্সের আরেক ফিকশন ‘শুক্লপক্ষ’ তেও তার অভিনয় ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ণজন্ম এর দুই কিস্তিতে আফরান নিশো বা মেহজাবিনের সাথে পাল্লা দিয়ে রীতিমতো সারপ্রাইজ করেছেন তিনি আমাদের তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে। আবার মিজানুর রহমান আরিয়ানের স্বল্পদৈর্ঘ্য ফিকশন ‘নটআউট’এ গুনী অভিনেত্রী ঈশিতার ছোট ভাইয়ের চরিত্রেও ছিলেন সাবলীল। চরকির আরেক আলোচিত সিরিজ ‘নিখোঁজ’এ তিনি ছিলেন উজ্জ্বল। পাশাপাশি ‘ঘুন’, ‘অদ্ভুত তো আপনি’, ‘তারা তিনজন’, ‘গালিবের প্রেম এবং বসন্তের কাব্য’ বা সাম্প্রতিক সময়ে সাড়া ফেলা ওয়েব সিরিজ ‘বোধ’ নিত্যনতুন কনটেন্টে ব্যতিক্রমী চরিত্রে নিজের প্রতিভার জানান দিয়ে যাচ্ছেন এই তরুন অভিনেতা।

একটি দৈনিকে সাক্ষাৎকারের সময় খায়রুল বাসার জানিয়েছেন আমাদের দেশে তার প্রিয় অভিনেতা হলেন, আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরীদি, আহমেদ রুবেল, শহীদুজ্জামান সেলিম, চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, শ্যামল মাওলা, মনোজ প্রামাণিক, সোহেল মণ্ডল। তাঁদের দেখে অভিনয় শেখেন তিনি। তবে আমাদের চারপাশের মানুষদের নিবিড়ভাবে দেখতে পারলে সবচেয়ে ভালো অভিনয় শেখা যায় বলেই ধারনা তার।

অভিনয় নিয়ে খায়রুল বাসারের পরিকল্পনা কি? জানতে চাইলে তিনি জানান, আসলে আমার জীবনে কিছু দায়বদ্ধতার পর একমাত্র ভালোবাসা অভিনয়ের প্রতি। এই ভালোবাসায় আমি দিনরাত ডুবে থাকি এবং থাকতে চাই। অভিনয়ে প্রতিটা কাজেই প্রচন্ড ভালোবাসা নিয়ে ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছি। তবে সব কাজেই কিছু আফসোস থেকে যায়। তারপর আবার নতুন নতুন কাজের প্রেমে পড়ি। এভাবেই অভিনয় নিয়েই আমি আমার সামনের পথ চলতে চাই। এছাড়া আমার কোনো পরিকল্পনা নেই।

পরিকল্পনা থাকুক বা না থাকুক আগামীর একজন দক্ষ অভিনেতা হিসেবে সম্ভাবনার যে ঝলক দেখিয়েছেন তিনি তা অব্যহত থাকবে এবং নিজের পরিশ্রম, কাজের প্রতি ভালোবাসা এবং ভিন্নধর্মী কনটেন্টে অভিনয় দক্ষতা দিয়ে নিজেকে নিজেই ছাড়িয়ে যাবেন এই তরুন অভিনেতা সেটাই কাম্য।

Ad