ডার্ক থ্রিলার গল্পের ‘বুলবুল’

আফজালুর ফেরদৌস রুমন : গত বছর আজকের দিনে নেটফ্লিক্সে মুক্তি দেয়া হয়েছিলো আনুশকা শর্মা প্রযোজিত আলোচিত এবং প্রশংসিত ওয়েবফিল্ম ‘বুলবুল’। একটি বাংলা উপকথার উপর ভিত্তি করে নির্মান করা ডার্ক হরর ঘরানার সিনেমাটি রিলিজের পর পরই আলোচনায় এসেছিলো। আজ ‘বুলবুল’ এর এক বছর পূর্ণ হলো।

একটু ফিরে দেখা যাক কেমন ছিলো আনুশকা শর্মা’র এই উনিশ শতকের শেষভাগের পটচিত্রে নির্মিত ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার একটি গ্রামের ফেলে আসা কিছু সময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন অস্বাভাবিক ঘটনা, বাল্যবন্ধুত্ব, প্রেম, সন্দেহ, অবিশ্বাস এবং প্রতিশোধের গল্প নিয়ে নির্মিত এই ভৌতিক থ্রিলারটি।

‘বুলবুল’ এর আগেই প্রযোজনায় নেমেই একের পর এক ছক্কা হাঁকিয়েছেন বলিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী আনুশকা শর্মা ৷ বড়পর্দায় তার প্রথম প্রযোজিত সিনেমা ‘এনএইচ টেন’ দিয়েই বাজিমাৎ করেছেন। তথাকথিত বলিউড ঘরানার বাইরে তার এই সিনেমা জয় করে নিয়েছিলো সবার মন সাথে বক্স অফিসেও সফলতা এনে দিয়েছিলো। তারপর ‘ফুল্লোরি’ এই সিনেমা বক্সঅফিসে সফল না হলেও সমালোচকদের কাছে প্রশংসা কুড়িয়েছিলো।

সর্বশেষ ‘পরী’ সিনেমাটি বাংলাদেশেরই একটি গল্প নিয়ে নির্মান করা হয়েছিলো। ‘পরী’ সিনেমাটিকে হরর ঘরনায় বলিউডের অন্যতম সেরা সিনেমা বললেও খুব একটা ভুল হবেনা। তিনটি সিনেমাতেই নারীপ্রধান গল্প এবং সাথে দুর্দান্ত স্ক্রিনপ্লে, সংলাপ, ভিএফএক্স, কাহিনীর সাথে পাল্লা দেয়া ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর সব মিলিয়ে আনুশকা শর্মা স্রোতের বিপরীতেই সাফল্য ছিনিয়ে এনেছেন৷

এই সময়ের বিনোদনের অন্যতম সেরা প্ল্যাটফর্ম হচ্ছে ওটিটি। এই ওয়েব প্ল্যাটফর্মে আনুশকা যাত্রা শুরু করেন ‘পাতাললোক’ দিয়ে। রিলিজের পরপরই ব্যাপক জনপ্রিয়তা এবং প্রশংসা কুড়ায় আনুশকা এবং তার টিম। অ্যামাজন প্রাইমে ‘পাতাললোক’ রিলিজ দেয়া হয়েছিলো। এই ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে রাজনীতি, প্রশাসন ও অপরাধজগতের এক অনন্য সমীকরণ আঁকা হয়েছে। যা মন্ত্রমুগ্ধ করেছে সাধারন দর্শক থেকে শুরু করে সেলিব্রিটিদেরকেও।

প্রশংসার বন্যায় ভাসছেন এর সাথে যুক্ত সবাই। ‘পাতাললোক’ এর জনপ্রিয়তার রেশ কাটতে না কাটতেই প্রযোজক আনুশকা হাজির হয়েছিলেন জনপ্রিয় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সের জন্য তার প্রযোজিত প্রথম সিনেমা ‘বুলবুল’ নিয়ে। হরর ঘরানার হলেও এক সুন্দর রহস্য এবং কাল্পনিক ঘটনা দিয়ে ঘুরেছে গল্পের মোড়। গল্পে এক ডাইনির রুপকথার সাথে যোগ হয়েছে এক রাজবাড়ি’র ভয়ঙ্কর কিছু অতীত।

সত্য এবং তার ভাইয়ের বাল্যবধু বুলবুলকে নিয়েই এই জমজমাট থ্রিলার। অল্পবয়সী মেয়ে বুলবুল। তার জীবনের কাহিনি এবং ডাইনির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে গল্প বুনেছেন নবাগতা পরিচালক অনবিতা। পরিচালনার পাশাপাশি স্ক্রিনপ্লেও তার। ‘বুলবুল’ সিনেমায় অভিনয় রয়েছেন পাওলি দাম, তৃপ্তি দিমরি, রাহুল বোস, অবিনাশ তিওয়ারি এবং পরমব্রত।

সিনেমাটির কিছু অংশের শুটিং হয়েছে মুম্বাইতে। বাকি সম্পূর্ন শুটিং হয়েছে কলকাতায়। কলকাতার বিখ্যাত বাওয়ালি রাজবাড়িতেই  সিনেমার ৯০ ভাগ শুটিং হয়েছে। এছাড়া হলদিয়ার মহিষাদল রাজবাড়িতে এবং কলকাতার হরতকি বাগান লেনের একটি বাড়িতেও শুটিং হয়েছে। সিনেমায়ার পোস্ট প্রোডাকশন হয়েছে মুম্বাইতে। শাহরুখ খানের রেড চিলিজ প্রোডাকশন হাউজে ভিএফএক্স এবং কালার কারেকশনের কাজ করা হয়েছে।

অভিনয়ের দিক থেকে এই সিনেমার প্রত্যেকেই অসাধারণ ৷ ‘লায়লা-মজনু’র তৃপ্তি দিমরি এই সিনেমাতে বেশ পরিণত। বাঙালি নারী হিসেবে তার সৌন্দর্য্য, সাজপোশাক এবং তাঁর প্রত্যেকটি অভিব্যক্তিতেই গল্পটি দেখতে আরো বেশি আগ্রহ এনে দিয়েছে। সত্য’র চরিত্রে অবিনাশও বেশ ভালো করেছেন। জমিদার হিসেবে রাহুল বোস নিজের জায়গায় একেবারে পারফেক্ট। জমিদার এবং তার পাগল ছোট ভাই দুটি চরিত্রেই নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন রাহুল বোস।

কখনো খলনায়িকা আবার পাগল স্বামী নিয়ে কখনো হিংসায় ভেতরে ভেতরে অন্তরজ্বালায় জ্বলতে থাকা নারীর চরিত্রে পাওলি দাম নজর কেড়েছেন আলাদা করে ৷ অল্প সংলাপ শুধু চাউনি দিয়েও যে অভিনয় করা যায় তা তিনি দেখিয়েছেন। এবং শেষে পরমব্রতের কথা না বললেই নয়। ‘পরী’র পরে আনুশকার প্রযোজনায় দ্বিতীয়বার অভিনয় করেছেন তিনি। ‘বুলবুল’ সিনেমায় গ্রাম্য এক ডাক্তারের চরিত্রেও আলাদা একটা ছাপ রেখেছেন তিনি।

অন্যভাবে বলা যায় প্রত্যেকেই এই সিনেমার অসাধারন চিত্রনাট্যকে আঁকড়ে ধরেছিলেন।  আর তাই হয়তো সিনেমাটি একবারের জন্যও পিছলে যায়নি। বরং অস্থির সময়ে দর্শককে ধরে রাখার জন্য সব রসদই ঠিকঠাক রেখেছেন পরিচালক অনবিতা৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র র লেখায় সেই সময়কার জমিদার বাড়ির অন্দরমহল এবং আড়ালে থাকা নারীদের সম্পর্কে উপন্যাসে যেরকম বর্ননা পড়েছিলাম আমরা তার কিছু ঝলক এই সিনেমায় দেখা যায় অনায়াসেই।

এই সিনেমার সিনেম্যাটোগ্রাফি গল্পের মেজাজকে ধরে রাখতে  সাহায্য করেছে বেশ সুনিপুণভাবে। বিশেষ করে প্রতিহিংসাকে বোঝাতে সিনেমাতে লাল রঙের ব্যবহার এবং গা ছমছমে ভাব আনতে নীল রঙের ব্যবহার অসাধারন। সিনেমাতে বাংলার লোকগাঁথার স্টাইল বেশ স্পষ্ট ছাপ রেখেছে।

যা কিনা সিনেমাটিকে একটি ‘ক্লাসিক’ লুক এনে দিয়েছে বেশ জোরালোভাবে। অসাধারন সংলাপ এবং তার যথাযথ ডেলিভারি চমৎকারভাবে আমাদের গল্পে মিশে যেতে সাহায্য করে। কস্টিউম নিয়েও ভালো গবেষনা করেছেন প্রোডাকশন একথা বলতেই হয়। সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে অমিত ত্রিবেদি।

আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয় যে, চাইলে এই সিনেমা টেনেটুনে অনায়াসেই আড়াই ঘন্টা বানানো যেতো। তবে এক্ষেত্রে পরিচালক বা এডিটর নিজেদের সংযত রাখতে সক্ষম হয়েছেন। অহেতুক দৈর্ঘ্য না বাড়িয়ে অসাধারন মেকিংয়ের ১ ঘন্টা ৩৪ মিনিটের ‘বুলবুল’ আমাদেরকে দর্শক হিসেবে তৃপ্তি দিয়েছে একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। যারা এখনো দেখেননি তারা দেখে নিতে পারেন নেটফ্লিক্সে এই জমজমাট ডার্ক থ্রিলারটি।

Ad